বেশকিছু দিন আগে ঢাকার মিরপুরে এক মহিলা ফকির দাবি করেন , তার বাড়ির ভেতর এক আউলিয়ার কবর আছে । তিনি সেই আউলিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে ঝাড়ফুক আর জড়িবুটি দিচ্ছেন । প্রচার করতে থাকেন , ‘ বাবা ’ তাকে স্বপ্নে বলে দেন , কোন রােগের ওষুধ কোনটি দিতে হবে । তিনি ‘ বাবা ’ র কবর স্বপ্নে খুঁজে পেয়েছেন । এই ‘ বাবা ’ হচ্ছে মহিলার কথিত স্বপ্নের কথিত আউলিয়া । ওই মহিলা মানুষকে বিশ্বাস করানাের জন্য প্রচার করতে থাকে , ‘ মুহাম্মদ ( সাঃ ) ই তাে স্বপ্নে আল্লাহর অনেক নির্দেশ পেয়েছেন । যে আউলিয়ার কথা মহিলাটি প্রচার করেন , ওই আউলিয়ার নাম ইতােপূর্বে কেউই শুনেছে বলে জানা যায়নি । তবে কোনাে মােল্লা একবারও বলেন না , এই ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসার কোন ভিত্তি নেই । তারা বলেন না , অনেক অসুখ এমনিতেই সেরে যায় এতে ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসার কোনাে অবদান নেই , ‘ ঝড়ে বক মরে , ফকিরের কেরামতি বাড়ে ।’ সবার মনেই ধর্মের অসারতা নিয়ে কথা বলার সাহসের অভাব । যার যখন খুশি সে ধর্মকে তখন সেভাবেই ব্যবহার করতে পারছে । এটা করেও অল্পসংখ্যক মানুষের অন্তত রুজি রুটির যােগান হচ্ছে । তবে বেশি সংখ্যক মানুষ হচ্ছে প্রতারিত । তাই ধর্মের অসারতা ধরিয়ে দিলে প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়তে হয় । কিন্তু ধর্মের অপব্যখ্যার মাধ্যমে গণহত্যা , নির্যাতন , নারী ধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে চলা যায় । পীর – ফকির – মাজার ব্যবসা আমাদের দেশের দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে । এক শ্রেণীর ভন্ড নিজেদেরকে পীর দাবী করে প্রতারণা করে যাচ্ছে । সহজ – সরল হতাশাগ্রস্ত ও সহজে আশা পূরণের জন্য তারা ওইসব পীরদের আস্তানায় যায় এবং প্রতারণার শিকার হয় । মানুষের দুর্বলতা , অজ্ঞতা , কুসংস্কারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রতারণায় লিপ্ত ওইসব কথিত পীররা । তারা ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও কুসংস্কারকে আকড়িয়ে ধরে আছে । তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত বলে প্রচার করে । তারা সব সময়ই তাদের বিরুদ্ধচারণকারীর বিরুদ্ধে সােচ্চার । তারা মানুষের চেতনাকে ভয় পায় । তবে মুখে ছলনার বারুদ ফুটে । তারা ধর্মের নামে মানুষের মানবিকতার চূড়ান্ত বিকাশের গতিকে রুদ্ধ রাখতে চায় । একটি তলােয়ারের ধর্ম যেমন তীক্ষ্মতা , আগুনের ধর্ম যেমন দহন , তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্বের বিকাশ । কিন্তু কথিত পীররা মানুষের মনুষ্যত্ববােধকে বিকশিত করতে ধর্মের নামে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে । মানুষের চিন্তায় , মানুষের চেতনায় বপন করতে চায় কুসংস্কারের বীজ । তারা কুসংস্কার দূরীকরণের কথা উঠলেই আঁতকে উঠে । কিন্তু ধর্মের অপব্যাখা করে থামিয়ে দিতে তৎপর হয় । কুসংস্কারই যে তাদের বড় হাতিয়ার । জনশিক্ষা ও যথার্থ বিজ্ঞান চেতনা আজও এ দেশে দুর্লভ । সেই দুর্লভতাকেই হাতিয়ার বানায় ভন্ড পীররা । ভন্ডপীররা মানুষের সব ধরণের সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম বলে প্রচার করে । আর এইসব সমধানে তারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ! একটি কাহিনী বলতে হয় , সিগারেট টানার অভিযােগ একজন তার ছেলেকে পিটান । বাবার হাতে মাইর খেয়ে ছেলেটি তিনদিন বাড়ি আসে না । তার খুঁজে পেতে ব্যাকুল পরিবার । এই কথাটি শুনার পর একজন জানালাে এক পীরের কথা , তাকে খুঁজে দিতে পারবে । প্রথম সাক্ষাতে তাকে হাদিয়া দিতে হবে ৩১৩ টাকা । তারপর সে একটি চুক্তিতে করবে । সর্বনিম্ন চুক্তি হলাে ৩ হাজার টাকা । এ কথা শুনে ওই ছেলের পরিবারের একজন কোনাে এক শুক্রবার জুম্মার নমাজের পর কথিত পীরের কাছে যান । কিন্তু তার অনেক আগেই ছেলেটি ফিরে আসে বাড়িতে । সংবাদটা পেয়েও যান তিনি । তবে পীরকে পরীক্ষা করার জন্য ৩১৩ টাকা হাদিয়া দেন । পীর এবার চুক্তি করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে । বলে পরী তাকে নিয়ে গেছে । তিনি তার তালুতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন । তিনি জীন চালান করে তাদেরকে দিয়েই ছেলেটিকে নিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন । কিছুদিন সময় লাগবে । ১০ হাজার টাকা দাবী করে ওই ভন্ড পীর । পরিস্থিতি অনুকুলে নাও থাকতে পারে , তাই আগত লােকটি ওতাে টাকা দিতে অপারগতার কথা বলে চলে আসেন । মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের নামে ব্যবসা করার প্রবণতা অনেক পুরনাে রীতি । এই সব আসে ভারতীয় উপমহাদেশে থেকে । সেই অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ধর্মব্যবসায় লিপ্ত পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্চের স্থানীয় একটি চক্র । ঝড়ে পড়ে যাওয়া একটি গামার গাছকে কেন্দ্র করে ‘ তুফান পীরের মাজার ’ গড়ে তােলা হয়েছে । কাগজে লিখে দেয়া হয়েছে “ নিয়ত করলে ফল মিলবে ‘ । অন্ধ বিশ্বাসে অনেকে মানত করতে শুরুও করে সেখানে । মাজারে জ্বলছে আগেরবাতি , মােমবাতি । টাকা পয়সা , গােলাপ জল , আগেরবাতি পড়ছে প্রতিনিয়ত । এ যেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘ লালসালুর গল্পেরই একবিংশ শতকের নতুন সংস্করণ । আরেকটি মাজারের কাহিনী পঞ্চগড়ে । সেই জেলার এক পল্লী গ্রামের নাম গজপুরী । ঝড়াে বাতাসে ওই গ্রামের দুটি বড় আকৃতির গামার গাছ পড়ে যায় । গামার গাছ স্থানীয়ভাবে পিঠালি গাছ নামে পরিচিত । একটি গাছ পাশের রাস্তার উপর পড়লে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায় । পরে গাছের মালিক তাৎক্ষণিক গাছটি স্থানীয় এক কাঠ ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন এবং দ্রুত গাছটি কেটে নিয়ে যেতে বলেন । কাঠুরিয়ারা প্রথমে সড়কের উপরে থাকা গাছের ডালপালা কেটে দেয় । ডালপালা কাটার পর গাছের মাথা হালকা এবং গােড়ার ভর বেশি হওয়ায় গাছটি নিজে থেকেই আবার আস্তে আস্তে আগের মতাে দাঁড়িয়ে যায় । গােড়ার মাটির ভরের কারণে গাছটি উঠে গেলেও স্থানীয় একটি চক্র গুজব ছড়িয়ে দেয় গাছটি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী । এরপর কাঠুরিয়ারা ভয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে বাড়ি চলে যায় । এই কথা দশ কান পর্যন্ত পৌছাতেই রাতারাতি ওই এলাকার ইসমাইল হােসেন নামের একজন লালসালু এনে তা মাজারের আদলে ঘেরাও করে ‘ তুফান পীরের মাজার হিসেবে ঘােষণা দিয়ে মুরিদ ও খাদেম বনে যায় । তার সাথে যােগ হয় গ্রামের আরও কিছু মানুষ । স্থানীয় একজন তার ফেসবুকে ‘ দুইশ বছরের আগের পীরের সন্ধান , উপড়ে পড়া গাছকে বার বার জীবন্ত করে ‘ শিরােনাম দিয়ে প্রচারও করেন । এরপর আর দশটি মাজারের মতই ওই গামার গাছের প্রাঙ্গন হয়ে উঠে তুফান পীরের মাজার হিসেবে । সেখানে লিখে দেয়া হয় , “ নিয়ত করলে ফল মিলবে । এরপর দূর দূরান্ত থেকে মানুষরা মাজারটি দেখতে আসতে থাকে । টাকা পয়সা দান – দক্ষিণা করার পাশাপাশি কথিত মাজারে মােমবাতি , আগােবাতি জ্বালানাে শুরু করে । এছাড়া কেউ দুধ ঢেলে মানত করে । দানে পড়া টাকা ওই চক্রটিই হাতিয়ে নিচ্ছে । ওই জেলার দেবীগঞ্জের সােনাহার ইউনিয়নের বটতলী বাজার থেকে গজপুরী গ্রামের সড়ক ধরে কয়েকশ মিটার সামনে গেলেই দেখা মিলবে কথিত ‘ তুফান পীরের মাজার । কবরের আদলে লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা দেয়া গাছটি । দেখা যায় , ভেতরে ভক্তদের দেয়া টাকা – পয়সা , তার সাথে আগেরবাতি , মােমবাতি ও গােলাপজলের স্তুপ । গাছটিতে লাল কাপড়ের উপর রঙিন প্রিন্টে কম্পােজ করা কাগজ আটকিয়ে দেয়া আছে । সেখানে লেখা আছে ‘ নিয়ত করলে , ফল পাবেন । তবে কে এই তুফান ? তার কোন পরিচয় দিতে পারে না স্থানীয় কেউই । তুফানে পড়ে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়ানাের ফলে গাছটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে প্রচার করে তুফান পীরের মাজার নামকরণ করা হয়েছে । তবে স্থানীয়দের অল্প ক ’ জন বাদে সবাই ওই মাজারের বিপক্ষে ঝড়ে গাছটি পড়ে গিয়ে আবার উঠে যাওয়ার পরপরই হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের দেবতা ভেবে পূজা অর্চনা শুরু করে । এরপর স্থানীয় এক যুবকসহ কয়েকজন সেখানে মুসলমানদের পীরের মাজার রয়েছে বলে জানিয়ে তাদেরকে বাধা দিয়ে তুফান পীরের মাজার ঘােষণা দেয় । । ওই স্থানে কখনাে কোন মাজার ছিলাে না । স্থানীয়দের কোন কবরও ছিল না । সেটিকেই এখন মাজার বানানাের হয়েছে । মাজারের প্রতি দুর্বল মানুষরা প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে সেখানে । অনেকেই নিশ্চিত হয়ে বলেন , গাছটির গোড়ায় অনেক মাটি ছিলাে । ডালগুলাে কেটে দেয়ার পর এড়িয়ে যায় । পরে এসে দেখা যায় , লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা দিয়ে সেটাকে ‘ তুফান পীরের মাজার করা হয়েছে । মানুষ দূর – দূরান্ত থেকে এসে মানত করে টাকা পয়সা দেয় । মােদ্দা কথা , এক শ্রেণীর মানুষ প্রতারিত করার জন্যই মাজার ব্যবসা শুরু করেছে । কেউ কেউ বলে ভূত আছে , কেউ বলে দেবতা আছে , কেউ বলে সাপ আছে । এখন সেটা মাজার হয়ে গেছে । অনেক মানুষ আসছে , দান করছে । তবে দানের টাকা রাতে কে বা কারা যেন নিয়ে যাচ্ছে । মাজারের কথিত খাদেম ইসমাইল । তুফান পীরের মাজারের ঘােষণাটা সেই প্রথম দেয় । সে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন লােকজনের সাথে প্রতারণা করার জন্য মাজারের রূপ দিয়েছে ।
রুকসানা রহমান