পন্থীর শাহর মাজারে ঢুকতে হলে জুতা খুলতে ঢুকতে হয় । এটাই নিয়ম । মাজারের মধ্যে রয়েছে আলাদা একটি ঘর , নাম দ্বারাই । ওই ঘরে বসে নাচ – গানের আসর । দ্বারাই ঢুকতে হলে মােমবাতি , আগরবাতি নিয়ে ঢুকতে হয় । এগুলাে না নিয়ে গেলে ঢুকতে বাধা দেয় মাজারের লােকজন । বন্ধ ঘরে ( দ্বারাই ) ঢুকে প্রথমে গাঁজার ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে যাবে । সেখানে সব সময়ই শােনা যাবে ফকির লালন সাঁইজীর গান । গায়ক বা শ্রোতাদের তেমন ভক্তিভাব না থাকলেও গাঁজাসেবন চলে ধুম ভাবে। গােলাপ শাহ ’ র মাজার ঢাকার গুলিস্তানে । ওই মাজারের ভক্তদের কাছে গােলাপ শাহ গুলিস্তানের গােলাপ ফুল । তিনি আল্লাহর কুতুব আউলিয়া , ভক্তদের বাবা । ইতিহাস থেকে জানা যায় , সংক্ষিপ্ত সেকান্দার শাহ্ ইয়ামেনি ২শ ’ বছর পূর্বে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে আগমন করেন । তার মৃত্যুর পর তাকে সসম্মানে নিমগাছতলী নামক স্থানে সমাহিত করা হয় । তখন এই মাজার নিমগাছতলীর মাজার নামে লােক মুখে পরিচিত হয়ে উঠে । এর কয়েক দশক পর গােলাপ শাহ্ নামে এক কামেল সূফীর আগমন ঘটে । সারা জীবন তিনি সেকান্দার শাহ্ ( বাবা ) ’ র খিদমতে কাটিয়ে দেন । পরবর্তিতে তাকে সেকান্দার শাহ্ ( বাবা ) ’ র ডান পাশে সমাহিত করা হয় তখন থেকে এই মাজারের নাম হয়ে যায় গােলাপ শাহ্ বাবার মাজার । মাজার পূজারীদের কাছে কবরে শায়িতরা ‘ বাবা ’ বলে আখ্যায়িত । ‘ গােলাপ শাহ্ বাবার মাজার ভক্তরা প্রচার করে , “ আজ পর্যন্ত গােলাপ শাহ্ মাজারের পাশে একবারের জন্যও কোনাে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেনি । অথচ প্রতিদিন এই মাজারের পাশ দিয়ে লক্ষ লক্ষ গাড়ি যাওয়া আসা করছে । এই মাজার চারিদিক দিয়ে লােহার তৈরি ছিদ্র যুক্ত বেড়া দিয়ে ঘেরা । গােলাপ শাহ্ বাবার দরগাহে হিন্দু , বৌদ্ধ , খ্রিস্টান , মুসলমান সকল জাতির মানুষ তাদের মানত পূরণের জন্য বাবার দরগাহে বাইরে থেকে টাকা পয়সা ফেলে মানত করে থাকে । তাদের সেই মানত আশ্চর্য জনকভাবে পূরণ হয়ে যায় । গােলাপ শাহ্ বাবার মাজার চৌরাস্তার মাঝখানে হওয়ায় এবং যানবাহন চলাচলে মাজারকে প্রতিবন্ধক মনে করে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসন আমলে বুলড্রোজার দিয়ে ভাঙ্গার প্রচেষ্টা করা হলে তা আপনা – আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং তাতে আপনা আপনি আগুন ধরে যায় । পরে স্বপ্নে এই নির্দেশ হয় যে , এই আওলিয়ার মাজার শরিফ ভাঙলে কেউ জীবিত থাকবে না । পরে তা আর কেউ ভাঙ্গতে পারেনি । প্রতি ৫০ দিন অন্তর মাজারে ভক্ত – আশেকানদের ফেলা টাকা বের করে বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংক ’ – এ জমা করা হয় । প্রতিমাসে ৩ – ৪ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে । প্রতিদিন শত শত লােক মাজার জিয়ারত ও দোয়া প্রার্থনা করতে আসেন , বৃহস্পতি ও শুক্রবার এর সংখ্যা ১০ গুন বেড়ে যায় । বাবা গােলাপ শাহ্ মাজারের চারপাশে জান্নাতি খুশবু – তে ভরপুর থাকে ২৪ ঘণ্টা , সেখানে ৫ মিনিট দাড়ালেই আপনার মনে হবে যে , আল্লাহর ফেরেশতারা যেন আকাশ থেকে আতর ঢেলে দিচ্ছে । বাবা গােলাপ শাহ মাজার শরিফের গায়ে একটি রহমতের শিকল রয়েছে , সেটা ধরে যদি কোন দুঃখী মানুষ আল্লাহর দরবারে কোন ফরিয়াদ জানায় , তাহলে তার ফরিয়াদ কখনও ব্যর্থ হয় না । ” ওই মাজারভক্তদের কথার তেমন কেনাে সত্যতা পাওয়া যায় না । মাজারের আগরবাতি জালানাে একটি প্রচলিত নিয়ম থাকায় সেখানে ওই গন্ধ ভরে থাকে । কারাে আসা বা মানত পূরােন কয়েছে , এমন কোনাে প্রমান আজ পর্যন্ত কেই দিতে পারেনি । মাজার প্রঙ্গণে সব সময় প্রচুর গাড়ি থাকে থামানাে বা স্বল্পগতিতে । ফলে দূর্ঘটনার তেমন কোনাে সুযােগ নেই । এরশাদ সরকারের আমলের কাহিনী মাজারভক্তদের নিজেদের সৃষ্টি । ও ধরনের কোনাে ঘটনার কথা কেউই শােনেনি । মাজারটিতে গেলে দেখা যায় , ময়লা কাপড় – চোপড় পরিহিত গলায় বিভিন্ন রঙের ফিতা বা মালা ঝােলানাে কিছু লোক বসে আছে । পাশের সড়ক বিভাজনের ওপর খিচুড়ি রান্না করছে কিছু লােক । মাজার প্রাঙ্গণে মােনাজাতরত বা কান্নারত কিছু লােককে দেখা যায় । এরা অবশ্য হতাশাগ্রস্থ মানুষ । দেখা যাবে , কিছু কিছু লােক মাজারের প্রাচীর মাথা ঠুটতে । এখানে স্থানাভাবের কারণে দেহব্যবসা বা গাজাখােরদের আচ্ছা নেই । তবে আশপাশের ফুটপাতে কাউকে কাউকে গাঁজাসেবন করতে দেখা যায় । তবে মাজারের অর্থ লুটপাট বিষয়টি সাধারণ নিয়ম । মাজারটিতে দৈনিক ১০ হাজারেরও বেশী টাকা পড়ে , যা দর্শনার্থীরা দান করে । কিন্তু মাস শেষে অর্থের এক – তৃতীয়াংশও পাওয়া যায় না । টাকা ভাগাবাটোয়ারা হয়ে যায় বিভিন্ন জনের পকেটে । ঢাকার অধিকাংশ মাজারে চলে জমজমাট গাঁজা , মাদক ও দেহব্যবসা । কিছু কিছু মাজারে গরীব , এতিম বা কোনাে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করার নামে ফান্ড খােলা হয় । ভক্তরা বিপুল পরিমাণ আগরবাতি , মােমবাতি , গোলাপজল এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার , মুরগি ও খাসি নিয়ে আসে মাজারের জন্য । মাজরের খাদেমরা এগুলাে আবার দোকানে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেয় । ঢাকার তুলানায় মাজার ব্যবসা বহুগুণে জমজমাট চট্টগ্রাম আর সিলেটে । এ দু ‘ জেলার কোনাে কোনাে মাজার পরিচালনার জন্য ৩ / ৬ মাস পর পর নিলাম ডাকা হয় । মাজার পরিচালনার কাজ পাওয়া যায় লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে । ডাক গ্রহীতরা ব্যবসা বাড়ানাের জন্য দর্শনার্থীদের মাজারে দান করতে নানা কৌশলে উৎসাহিত করে । বাংলাদেশের মাজারগুলােতে কথিত মারফতি সংস্কৃতি চলে । মাজারে সবসময় যারা অবস্থান করে তাদেরকে বলে আশেকান । আশেকানরা বিরতীহীন চালায় নাচ – গান । । ভক্তরা তাদের মানত নিয়ে মাজারে আসে । সেগুলাে ভােগ করে মাজারের খাদেমরা । শাহ পরানের মাজার প্রাঙ্গণের পুকুরের পাড়ে দোতরা নিয়ে নাচ – গান করে বিভিন্ন ধর্মের – বর্ণের মানুষ । ভক্তদের গায় ‘ লা ইলা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ রাসুল । মাজারগুলােতে সারা রাত আশেকান – ভক্তে ভিড় থাকে । আশেকান – ভক্তদের বিশাল সমাবেশ , গান – বাদ্য আর ভক্তির নিবেদনমুলক জিকির নৃত্য । বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজার । ওই মাজারের রাস্তা সব সময়ই লােকে লােকারণ্য থাকে । অথচ মসজিদে নামাজের সময় তেমন লােক হয় না । মাজারের এলাকাতে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু লােক আছে আগন্তকদের হেঁকে ধরে , রীতিমত টানাটানি শুরু করে । কিসের জন্য এই টানাটানি জানেন ? মাজার এলাকাতে শুধু খানজাহান আলীরই কবর নেই , আরও দুইটি বা তিনটি পীরেরও কবর আছে ( একটার নাম , ঠান্ডা বাবা । যারা টানাটানি করে তারা বিভিন্ন পীরের খাদেম । তারা সকলেই তাদের পীরের কবরের কাছে নিয়ে যেতে চায় । তাদের মধ্যে খানজাহান আলীর খাদেমরা বেশ তাগড়াই । টানাটানিতে তারই জিতে । কোন কথা বলার সুযােগ না দিয়েই তারা হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে খানজাহান আলীরই কবরের কাছে ! একটা ঘরের মধ্যে নকশা করা কাপড় দিয়ে ঢাকা কবর । সেখানে নিয়ে গিয়েই কবর ঢাকার কাপড়ের এক কোণা একে একে সকলের মাথার উপর চড়িয়ে দোয়া পড়বে । সে কি দোয়া পড়বে আল্লাহ ছাড়া কেউই জানবে না । এর পর ১১১ টাকা করে দান বাক্সে রাখতে তারা বাধ্য করে । মাজারের খাদেমরা ‘ বাবার কবরের পাশে জ্বালানাে আগর বাতির ছাই যত্নের সাথে সংগ্রহ করে রাখে । তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুরু করে বাবার মাজারে টাকা দান করলে ইহকাল – পরকালে কতাে ফায়দা হবে তার হিসেব । খাদেমরা বলবে , বাবার কবর ঢাকা কাপড় পুরানাে হয়ে গেছে , সেটা কিনার টাকা দিলেঅনেক ফায়দা হবে । তারপর গছিয়ে দিবে কিছু তাবিজ । অবশ্যই তাদের চাহিদামাফিক টাকার দিতে হয় । তাবিজগুলাে ভরা হয় আগর বাতির ছাই দিয়ে । এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে আগতদের নিকট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় খাদেম নামধারীরা । খানজাহান আলীর খাদেমদের প্রতারণা শেষ হওয়ার পরপরই অন্যান্য পীরের খাদেমরা আগতদের পিছু নেয় । তারা ওদের বাবার কাছে নিয়ে যেতে জোর প্রচেষ্টা চালায় । সেখানেও একই কাহিনী । প্রথমে দোয়া , পরে লেকচার , এরপর চাঁদা । খানজাহান আলীর মাজারের পাশে রয়েছে বিখ্যাত দিঘী । কোন কুমির দেখা না গেলেও কুমিরের জন্য মুরগী ছদকা দিতে কথার ফাঁদে ফেলে অনেকটা বাধ্য করা হয় । মুরগি সদকা দিলে , মানে কুমিরকে মুরগী খাওয়ালে , এতে মনােবাসনা পূর্ণ হয় ! যদি কেউ মুরগী সদকার কথা প্রকাশ করে তাহলে খাদেমদের মধ্যে হুড়ােহুড়ি লেগে যায় , কে মুরগী বিক্রি করতে পারে । হুড়ােহুড়ির মধ্যেই মুরগি নিয়ে আসবে কেনাে এক খাদেম । দর কষাকষি হবে , স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দামে মুরগি কিনতে হয় । শুরু হবে কুমিরকে মুরগি খাওয়ানাের পালা । নেতা খাদেম মাজার থেকে বের হয়ে সদকাকারীকে নিয়ে দ্রুত নিয়ে যাবে । এরই মধ্যে শিষ্য খাদেমরা বড় মুরগির সাথে অপেক্ষাকৃত ছােট মুরগি বদলে দেবে ! এরপর অনেক ঘুরপথে বিভিন্ন অলি গলি , বাড়ি ঘর পেরিয়ে খাদেম নিয়ে যাবে একটা ডােবার পাশে । ওখানে কুমিরকে এক মহিলা গরুর ভুঁড়ি কেটে কেটে খাওয়ায় ! নেতা খাদেম এসেই সেই কাটা হুঁড়ির কিছু অংশ কুমিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলবে ‘ বাবা ’ সদকা কবুল করেছেন সুতরাং আগতরা যেতে পারেন ! অবাক হলেও কিছু করার নেই । মুরগিটি শিষ্য খাদেম নিয়ে যাবে । আউলিয়ার মাজারে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা অর্জন স্বাভাবিক ব্যাপার । ধর্মভীরু বা ধর্মান্ধরা শুধু বিশ্বাসের বশে আউলিয়ার আশীর্বাদ পেতে সেখানে যায় । মাজারের খাদেমরা বিভিন্ন বাহানায় তাদের সাথে প্রতারণা করে , শােষণ করে । হাজার হাজার মানুষ এভাবেই প্রতারিত হচ্ছে প্রতিদিনই । বাগেরহাটে একজন বড় আউলিয়াকে কেন্দ্র করেই এসব প্রতারণা হয় । সারাদেশের আনাচে কানাচে কত শত যে পীরের মাজার আছে তার কোন হিসেব নেই । প্রতিটি স্থানেই হচ্ছে অন্ধ বিশ্বাসের চর্চা । বাধা দেবার উপায় নেই । কারন ধর্মইতাে আউলিয়াদের সন্মান করতে বলেছে । ধর্মের আফিমই আমাদের এসবের দিকে ধাবিত করছে । এক সময় এই ধর্মই নাকি মানুষকে অন্ধকারের যুগ থেকে বের করে এনেছে , সেটিই এখন মানুষকে আবার অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । যে লােক । জীবনেও কোরান পড়েনি বা অর্থ না জেনে পড়েছে তাকেও নাকি বিশ্বাস করতে হবে কোরান সত্য , কোরান মহান , এতে পৃথিবীর আবিষ্কৃত অনাবিষ্কৃত সব তথ্য লিখা আছে ! কিছু কিছু ওস্তাদরাতাে আরও এক কাঠি সরেস , তারা বিশ্বাস করে ইহুদী নাসারা নাকি কোরান অ্যানালাইসিস করেই সব আবিষ্কার করছে । তাহলে বলতে হয় , কোরান যাদের ধর্মগ্রন্থ তারা পানিপড়া , ডিমপড়া খাওয়ার যুগেই পড়ে আছে !
রুকসানা রহমান