সমস্যা ব্যতিরেকে মানুষ নেই , সমস্যা মানুষের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে । সভত্যার উষালগ্ন থেকেই সমস্যা যে মানুষের নিত্যসঙ্গী তা বুঝতে সক্ষম হয় মানুষ । তবে আদিকাল থেকেই মানুষকে সমস্যার সাথে যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হয়েছে । কালের বিবর্তনে এই সমস্যার প্রকৃতি হয়তাে বদলিয়েছে , কিন্তু মানুষের জীবন কখনােই কিংবা কোনাে যুগেই সমস্যামুক্ত হয়নি । মানুষের আদি সমস্যা হলাে ক্ষুন্নিবৃত্তি । আদিম যুগে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিলাে শিকার । তখনকার মানুষেরা তাদের মেধা এবং শ্রমের পুরােটাই প্রয়ােগ করতাে এই শিকারের পিছনে । তারা লক্ষ্য করে দেখে যে , শিকারের জন্য শুধু মেধা এবং শ্রম যথেষ্ট নয়- ভাগ্যও এর সাথে জড়িত । তখন থেকেই মানুষ ভাগ্যকে জয় করার জন্য অলীক কিছুর প্রতি নতজানু হতে শেখে । যে সমস্যার সমাধান মানুষের নাগালের বাইরে , তার সমাধান আছে শুধু অলৌকিকতার মাঝে- এই প্রত্যয় ক্রমশ দৃঢ়ভাবে দানা
বাঁধতে শুরু করে মানুষের মননে , সেই আদিম যুগ থেকেই । কালের আবর্তনে এই প্রত্যয় কেবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে । অর্ধেক পৃথিবী জয় করা চেঙ্গিস খানকেও আমরা দেখি , আকাশ দেবতার রােষানলে পড়ার শঙ্কায় শঙ্কিত হতে । তার সেনাপতিদের দেখি , যুদ্ধে যাবার আগে যুদ্ধ দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পূজার আয়ােজনে একনিষ্ঠ হতে । মানুষের এই গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বাসকে পুঁজি করেই সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ গুণীন সেজে আবির্ভূত হয় যুগে যুগে । তাদের মূল কাজ , মানুষকে চাহিদা মতন অলৌকিকতার আশ্বাস দেয়া । পরবর্তীতে ধর্মের সাথে মিশে এই কথিত গুণীনদের নতুন পরিচয় হয়েছে পীর , ফকির কিংবা তান্ত্রিক । পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতন আমাদের দেশেও এই পীর – ফকিররা বিস্তার লাভ করেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে । কবি জসীম উদ্দিনের বিখ্যাত বাঙ্গালীর হাসির গল্প ’ – এর শেষ গল্পটি হচ্ছে , ‘ শেয়ালসা পীরের দরগা । কীভাবে শিয়ালের বিষ্ঠার উপর চতুর রহিম শেখ পীরের দরগা স্থাপন করেছিলাে সেটাই ব্যঙ্গ রসাত্মকভাবে বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে । আবার সমাজে পীরের দরগার সুগভীর প্রভাবকে চিত্রিত করেছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ তার ‘ লালসালু ‘ উপন্যাসে । ভীন গ্রাম থেকে আগত মজিদ সুনিপুণ চতুরতার আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি গড়ে তুলে ‘ মােদাচ্ছের পীরের দরগা । আর এই দরগাকে পুঁজি করে ক্রমশ সে গ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয় । ওপার বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক মুস্তাফা সিরাজের ‘ অলীক মানুষ ’ উপন্যাসে উঠে এসেছে তদকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুসলিম সমাজের চিত্র । এই উপন্যাসের প্রাণপুরুষ বদিউজ্জামান আল খােরাসানী একজন ইমাম , যিনি তার পরিবার আর একদল অনুসারীদের নিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে বেড়ান উপযুক্ত পরিবেশের সন্ধানে । ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তিনি ছিলেন আপােষহীন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠাবান । নিজে ছিলেন পীরতন্ত্রের ঘাের বিরােধী অথচ অলীকতায় বিশ্বাসী গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাকেই কিনা পীর হিসেবে মানতে শুরু করে । অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম বদিউজ্জামান অবশ্য একসময় গ্রামের মানুষদের এই ধারণাকে প্রশ্রয় দেয়া শুরু করেন । তার দুই সন্তানের একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী । সেই সন্তানের আরােগ্য কামনায় তার স্ত্রী তার অজান্তে পরিত্যক্ত এক পীরেরদরগায় মানত দেয় । এরপর যখন সেই পুত্রের মানসিক বিকাশের কিছুটা উন্নতি হয় , তখন তার স্ত্রীর মনে জায়গা করে নেন পীরের দরগার ক্ষমতা , অথচ ধর্মে তা সম্পূর্ণ বারণ । আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি , যেখানে পীরতন্ত্র একটি গ্রহণযােগ্য উপাদান । সমাজের স্তরভেদে এই পীরতন্ত্রের অবয়ব ভিন্ন । আবার বিশেষ বিশেষ পীর তরিকায় দেখা যায় , সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের অবাধ সুযােগ । তবে সেক্ষেত্রে আয়ােজকদের নিতে হয় বিপুল কর্মযজ্ঞের উদ্যোগ । আটরশি পীরের আখড়া হচ্ছে সেরকম এক উদ্যোগ , যা একসময় সারা দেশব্যাপী আলােচিত হয় । সেখানে ছিলাে অসংখ্য মানুষের আনাগােনা এবং সকাল সন্ধ্যা জুড়ে ছিলাে উৎসবের আমেজ । আটরশি পীরের মতন আরাে কিছু পীর আমাদের দেশে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলাে কিংবা এখনও করে যাচ্ছে । এদের মধ্যে শর্ষিনার এবং চরমােনাইয়ের পীর অন্যতম । স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভ্রমনে এসে বেনজির ভুট্টো শর্ষিনার পীরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে খবরের কাগজের শিরােনাম হয়েছিলেন । জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘ জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন শর্ষিনার পীরের কীর্তি কাহিনী । তার বাবা যখন নিখোঁজ , তারা পুরাে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন এই পীরের আস্তানায় । তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই পীরের সাথে পাকিস্তান আর্মির যােগাযােগ । বর্তমান কালে চলমান রাজনীতিতে সক্রিয় চরমােনাইয়ের পীর । তবে তিনি তার পীর পরিচয় দূর করার জন্য সচেষ্ট । সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্প্রতি বলেছেন- “ ক্ষমতা আল্লাহর , পীর ও দরবারের ক্ষমতায় বিশ্বাসীরা জাহান্নামী । আমাদের মাঝে কাউকে কাউকে আমরা দাবী করতে দেখি পীর বংশের লােক হিসেবে । এই দাবী করে তারা কী বার্তা অনেক ক্ষেত্রেই তা অস্পষ্ট । কর্নেল ফারুককে ফাঁসির আগে যখন জেলখানার ইমাম তওবা পড়াতে আসেন , তখন তিনি তার কাছ থেকে তওবা পড়তে রাজী হননি । তিনি নিজেকে পীর বংশের লােক হিসেবে পরিচয় দেন । দাবী করেন যে , তার বংশে অনেকেই নাকি ‘ জিন্দা পীর । তবে আমাদের দেশে রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন পীরদের সংখ্যাই বেশী । আর তাদের টার্গেটও ভিন্ন । ভিন্ন । যেমন আশির দশকে বাংলাদেশের দৈনিকগুলােতে ‘ সায়েদাবাদী পীরের দোয়ায় সন্তানলাভ ‘ এই শিরােনামে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখা যেত । বর্তমানে অবশ্য এই পীরের আর কোনাে নামডাক শােনা যায় । সন্তানহীন দম্পত্তিরাই ছিলাে তার টার্গেট । সম্প্রতি দেখা দিয়েছে ‘ হজ্ব বাবা ‘ নামক এক পীরের , যার টার্গেট হচ্ছে , যেসব গরীব মুসলমানদের হজ্ব করার মতাে আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা । কাবা শরীফের রেপ্লিকা বানিয়ে নিজ আস্তানার আঙ্গিনাতেই হজ্ব করাচ্ছেন তিনি অল্প টাকার বিনিময়ে । ঢাকার মােহাম্মদপুরে দেখা দিয়েছিলাে মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ ‘ হাঁটা বাবা ’, যার কাজ ছিলাে অবিরাম হাঁটা । আর তার হাঁটার সঙ্গী হতাে হাজার হাজার মানুষ । সেই হাজার মানুষের হাঁটার ভিড়ে ধান্দাবাজী করতাে ‘ হাঁটা বাবা’কে ঘিরে থাকা একটি চক্র । সমাজে পীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে কাজটি অবশ্যই করণীয় সেটি হলাে , এমন কিছু করা , যাতে সাধারণ মানুষেরা ‘ টাসকি খেয়ে যায় । লােকমুখে শােনা , আরিচার এক পীরের খাওয়ার দাওয়াত পড়ে পাশের গ্রামে । পীর বলে কথা , তাই গ্রামবাসীরা লেগে গেলাে পঞ্চাশ পদের মুখরােচক ব্যঞ্জনের আয়ােজনে । পীর সাহেব দাওয়াতে এসে শুধু কাচকি মাছের ঝােল দিয়ে অল্প একটু ভাত দিতে বললেন । এতাে পদের মাছের আয়ােজন , অথচ সামান্য কাচকি মাছের ঝােলটাই করা হয়নি । মানুষজন ‘ টাসকি ’ খেয়ে গেলাে , আর ওই পীরের কুদরতির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লাে । সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা স্বপ্ন দেখে কোন এক অলীক ছোঁয়ায় পরিবর্তন হবে তাদের ভাগ্যের , ধরা দিবে সৌভাগ্য । সেই অলীক ছোঁয়ার সন্ধানে তারা মুখাপেক্ষী হয় ভাগ্য গণনাকারীদের । সমাজের স্তরভেদে এই ভাগ্য গণনাকারীদের চেহারাও ভিন্ন । রাস্তার পাশে টিয়া পাখী দিয়ে যেমন ভাগ্য গণনার ব্যবস্থা আছে , তেমনি আছে অভিজাত পাড়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত ‘ মহাজাতক ‘ – দের চেম্বার । ফলাফল কিন্তুএকই । সবাই আপনাকে এক অলৌকিকতার আশ্বাস দিয়ে টাকা – কড়ি হাতিয়ে নিবে । আবার অনেকে সম্মানীর বদলে ভাগ্য পরিবর্তনকারী পাথরের দামটাই শুধু নিবে । যেমন রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে আস্তানা গাড়া সম্পূর্ণ অশিক্ষিত লিটন দেওয়ান । এতে দর্শনার্থীদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও , গণনাকারীদের ভাগ্যের চাকা ঠিকই ঘুরে । ঢাকার জিপিওর সামনে ফুটপাথে বসে এমনই এক টিয়া পাখী দিয়ে ভাগ্য গণনাকারীর সম্পত্তির তালিকা ছিলাে দীর্ঘ- গুলশানের বাড়ী , আধুনীক গাড়ী , ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন সমাজের উচ্চবিত্তের অন্তর্ভূক্ত । অনেক পীর আবার তার লেবাস আর দৈহিক আকৃতি দিয়ে মানুষজনকে ‘ টাসকি লাগিয়ে দেন । তারা ‘ প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী মন্ত্রে বিশ্বাসী । ঢাকার দেওয়ানবাগীর পীর হচ্ছে এই ক্যাটাগরীর । এই পীরের দাবী তার সাথে নাকি আল্লাহ তা’য়ালার সরাসরি কথাবার্তা হয় । রােহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন দলে দলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছিলাে , তখন আল্লাহকে ‘ বেশ চিন্তিত ’ দেখেছিলাে এই পীর । আমাদের সমাজে আবার মিশে আছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পীরের দরগা শরীফের নাম । আজমীর শরীফ কিংবা খাজা বাবার দরগা হচ্ছে সেই ঘরানার । ছােটবেলায় আমাদের বাসায় চিঠির ভেতর আজমীর শরীফ থেকে শুকনাে গােলাপ পাঁপড়ি আর তবারক আসতাে , সাথে মানি অর্ডার ’ – এর ফর্ম । আমার ধারণা বাংলাদেশের অনেক মানুষেই এই চিঠি তখন পেতেন ।
শুধু ইসলাম ধর্মে কিংবা আমাদের সমাজেই নয়, এই পীর প্রীতি কিন্তু অন্য ধর্মে কিংবা অন্য সমাজে বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজেও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত । পীরতন্ত্রের মূলে রয়েছে স্টান্টবাজী । তাই এই প্রজেক্টের প্রতিটি ধাপে থাকতে হবে এই উপাদান । প্রথমে নির্বাচন করতে হবে একজন পীর যাকে লােকচক্ষুর অন্তরালে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে রাখতে হবে কয়েক মাস । এতে তার গাত্রবর্ণে এক ধরণের উজ্জ্বলতা আসবে , তাতে সাধারণ মানুষেরা ‘ টাসকি খাবে তার নূরানী চেহারা দেখে । এই কয়েক মাসের অন্তরীণ জীবনে তাকে কণ্ঠস্থ করতে হবে কোরআন শরিফের বেশ কিছু আয়াত যা সাধারণত নামাজের সময় পড়া হয় না । অর্থাৎ পীর যখন আরবীতে অনর্গল কোরানের আয়াত বলে যাবে , সাধারণ মানুষেরা সেখানেও ‘ চমক ‘ দেখবে । এই নতুন পীরের যাত্রা শুরু হবে ‘ পবিত্র ওরস মােবারক ’ দিয়ে । কোরবানী ঈদের আগে আগে এই ওরস মােবারকের আয়ােজন করতে হবে । কোরবানির হাটের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরু ছাগলের যে যাত্রা শুরু হয় , সেই যাত্রার সামনে লাল কাপড়ে ‘ পবিত্র ওরস মােবারক ‘ লেখা ব্যানার নিয়ে মানুষদের টানতে হবে মিছিলে । সাধারণ মানুষেরা ভাববে সঙ্গের সব গরু ছাগলগুলাে বুঝি ব্যবহৃত হবে ওরসের খানায় । দল ভারী হবে তাতে । মিছিল যখন ওরসের ময়দানে এসে জমায়েত হবে , পথের পরিশ্রমে সবাই হবে ক্লান্ত , সারা শরীরে হবে ব্যথা বেদনা , অনেকেরই হবে পেটের পীড়া । ফ্লাজিল আর প্যারাসিটামল মিশানাে পানি পীরের পড়া–পানি হিসেবে দেয়া হবে সবাইকে । হাতে–নাতে ফল পেয়ে সাধারণ মানুষেরা আবারও ‘ টাসকি খাবে । তারপর পীর যখন মঞ্চে উঠবেন তার নূরানী চেহারা তাে আছেই মানুষদের চমকে দেয়ার জন্য । অর্থাৎ চমকের পর চমক । এতেই প্রতিয়মান হয় , পীর ব্যবসা হচ্ছে আসলেই একটি পরীক্ষিত লাভজনক ও নিরাপদ ব্যবসা।
লেখিকা : নারীবাদী রুকসানা রহমান