নারীবাদ’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে উদ্ভূত একটি দর্শন। ১৮৩৭ খ্রিঃ ফরাসি দার্শনিক ও ইউরোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে প্রথম ‘নারীবাদ’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ‘নারীবাদ’ (ভবসরহরংস) এবং ‘নারীবাদী’ (ভবসরহরংঃ) শব্দ দুটি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২–তে, যুক্তরাজ্যে ১৮৯০–তে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০–তে। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী ‘নারীবাদী’ শব্দের উৎপত্তিকাল ১৮৫২ সাল এবং ‘নারীবাদ’ শব্দের ক্ষেত্রে তা ১৮৯৫। সময়কাল, সংস্কৃতি ও দেশভেদে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীবাদীরা বিভিন্ন কর্মসূচি ও লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করেছেন।
মানুষ হিসেবে পুরুষের তুলনায় সর্বার্থে নারীর সমতা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। নারীবাদ সমাজে নারীর সমতা অর্জন, বিশেষ করে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের যৌক্তিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। নারীবাদ দাবী করে, পুরুষের তুলনায় তারা একদিকে সক্ষম অন্যদিকে সামাজিক অবদানের দিকদিয়েও পুরুষ থেকে কম নয়।
নারীবাদী কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, সমাজে বিদ্যমান লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান। নারীবাদী কর্মকান্ড সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রদত্ত বিভিন্ন মতবাদ ও আন্দোলনকে নির্দেশ করে। নির্বাচনী ভোটাধিকার, উত্তরাধিকারী সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বৈবাহিক জীবনে সমানাধিকার, রাজনীতি ও ব্যবসায় সমান সুযোগ, সমান কাজে সমান বেতন, মাতৃত্ব–অবসর ইত্যাদির নারীবাদী প্রবক্তাদের মৌলিক দাবী। ঐতিহাসিকভাবে নারীরা বঞ্চনার শিকার। তাই নারীবাদীরা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
নারীবাদীরা নিজ দেহের উপর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করেন এবং ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ ও পারিবারিক নিগ্রহ থেকে নারী ও বালিকাদের রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকেন। বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নারীবাদী হতে পারেন যেকোনো লিঙ্গের বা শুধুমাত্র কোনো নারী (এই ক্ষেত্রে নারীবাদী পুরুষরা হবেন উপনারীবাদী বা ‘প্রোফেমিনিস্ট’) যিনি নারীবাদে বিশ্বাসী।
নারীবাদী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নারীবাদী তত্ত¡ সমাজে নারীর ভূমিকা ও জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে লিঙ্গবৈষম্যের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করে। সমাজ কর্তৃক নির্ণীত যৌনতা ও লিঙ্গের ধারণা প্রভৃতি জটিল বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য এই তত্ত¡ বহু শাখায় বিভক্ত। নারীবাদের কোনো কোনো শাখা শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত ও সাক্ষর জনগোষ্ঠীসমূহকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার জন্য সমালোচিত হয়েছে এবং এরই ফলে বিভিন্ন জাতিবিশেষের প্রতি নিবিষ্ট ও বহুসাংস্কৃতিক নারীবাদী ভাবধারার উদ্ভাবন ঘটে।
ইতিহাসে লিঙ্গবৈষম্যের নিরসনকারী প্রায় প্রতিটি সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে নারীবাদীদের নাম করা হয়। বিশেষত পাশ্চাত্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের অবদান প্রশ্নাতীত, যথা– নারীর ভোটাধিকার, ভাষার লিঙ্গনিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীন বেতন–কাঠামো, প্রজনন–সংক্রান্ত অধিকার (গর্ভনিরোধক ও গর্ভপাতের অধিকার), বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার ও সম্পত্তির মালিকানার অধিকার।
নারীবাদ মূলতঃ নারীর অধিকারের বিষয়টি নিয়ে সরব হলেও লেখিকা বেল হুক্স প্রমুখের মতে পুরুষের মুক্তির বিষয়টিও গুরুত্ব পাওয়া উচিত, কারণ আগ্রাসী পিতৃতন্ত্রের ফলে পুরুষরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
নারীবাদী তত্ত¡, যা নারীবাদী আন্দোলন থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, তার উদ্দেশ্য হলো নারীদের সামাজিক ভূমিকা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিঙ্গবৈষম্যকে বোঝার চেষ্টা করা। এর উপর ভিত্তি করে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা তৈরী হয়েছে যা জেন্ডার ইস্যুগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
কালের পরিক্রমায় অনেক নারীবাদী আন্দোলন এবং আদর্শ তৈরী হয়েছে যেগুলোর প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী এবং লক্ষ্য উপস্থাপন করে। এর মাঝে কতগুলো ধারা সমালোচিত হয়েছে যেমন, নাগরিক অধিকার আন্দোলন বা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন যেগুলোকে বলা হয় যে, এগুলো শুধুমাত্র সাদাদের, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরে। এই সমালোচনা থেকে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কেন্দ্রীক নারীবাদের সূচনা হয় যার মাঝে কালো নারীবাদ এবং ইন্টারসেকশনাল নারীবাদ অন্তর্ভুক্ত।
অধিকাংশ পাশ্চাত্য নারীবাদী ঐতিহাসিক মনে করেন যে. যে সমস্ত আন্দোলন নারীর অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করেছে তাদের সব কয়টিকেই নারীবাদী হিসেবে গণ্য করা উচিৎ; তারা নিজেদেরকে ওই নামে চিহ্নিত না করলেও এর অন্যথা হয় না। অন্য ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ‘নারীবাদী’ শব্দটি শুধুমাত্র আধুনিক নারীবাদী আন্দোলন ও তার উত্তরসূরি আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই দ্বিতীয় দলের ঐতিহাসিকরা পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোকে চিহ্নিত করতে ‘উপনারীবাদ’ কথাটির অবতারণা করেছেন।
আধুনিক পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তিনটি ‘তরঙ্গ’-এ বিভক্ত। নির্দিষ্ট কিছু নারীবাদী লক্ষ্যের এক একটি আঙ্গিক নিয়ে এক একটি ঢেউ কাজ করেছে। প্রথম ঢেউ–এর সময়, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগে নারীর ভোটাধিকার অর্জনের উপর জোর দেয়া হয়। দ্বিতীয় ঢেউ বলতে ১৯৬০ দশকে নারীমুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া মতাদর্শ ও কর্মসূচীসমূহকে বোঝায়। এই সময়ে নারীর সামাজিক ও আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জোর দেয়া হয়। তৃতীয় তরঙ্গ হল দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ১৯৯০ এর দশক থেকে শুরু হওয়া একটি ভিন্ন অভিমুখী ধারাবাহিকতা। এই পর্যায়ে লিঙ্গনির্ভর প্রথাগত সামাজিক মূল্যবোধের একাধিক আমূল পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করা হয়েছে ও হচ্ছে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকের কতগুলো কার্যকলাপের ধারাবাহিকতাকে নারীবাদের প্রথম ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে চুক্তির সমঅধিকার, বিবাহ, বাচ্চার দেখভাল এবং নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে আন্দোলন চলছিলো। উনিশ শতকের শেষের দিকে এ আন্দোলন নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, বিশেষভাবে নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়, যদিও কিছু নারীবাদী তখনো নারীদের লিঙ্গগত, পুনরুৎপাদনমূলক এবং অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন।
এছাড়াও ওই শতকের শেষের দিকে ব্রিটেনের অস্ট্রেলিয়ান উপনিবেশগুলোতে নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৮৯৩ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয় এবং দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ১৮৯৫ সালে নারীদের ভোটাধিকার এবং পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার দেয়। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া ১৯০২ সালে নারীদের ভোটাধিকার প্রবর্তন করে।
নেদারল্যান্ডে, উইলহেলমিনা ড্রুকার (১৮৪৭–১৯২৫) তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক এবং নারীবাদী সংগঠনের সাহায্যে ভোটাধিকার এবং সমঅধিকারের জন্য সফলভাবে আন্দোলন করেন।
ব্রিটেনে ভোটাধিকার আন্দোলনকারীরা নারীদের ভোট দেয়ার অধিকারের সপক্ষে প্রচার শুরু করে। ১৯১৮ সালে রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপল অ্যাক্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে কমপক্ষে ৩০ বছর বয়সী নারী যাদের সম্পত্তি আছে তাদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। ১৯২১ সালে এই আইন সংশোধন করে ২১ বছরের বয়সী সকল নারীর জন্য ভোটাধিকার প্রবর্তন করা হয়। এমিলিন পাঙ্ঘরস্ট ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অ্যাক্টিভিস্ট, যাকে টাইম পত্রিকা একুশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, “তিনি আমাদের সময়ের নারীদের সম্পর্কে ধারণা দেন এবং সমাজকে ঝাঁকি দিয়ে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছেন যেখান থেকে পিছু ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রে তালিকায় লুক্রেশিয়া মট, এলিজাবেথ ক্যাডি স্টানটোন, সুসান বি এন্থনি এর নাম উল্লেখযোগ্য। তারা সকলেই ভোটাধিকার আন্দোলনের পূর্বে দাস প্রথা বিলোপে সংগ্রাম করেছেন। তারা কুকার এর আত্মিক সমতার ধর্মতত্তে¡ বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে নারী এবং পুরুষকে ঈশ্বরের অধীনে সমান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ১৯১৯ সালের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর সাথে সাথে নারীবাদের প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে বলে মনে করা হয়, কেননা এ সংশোধনীতে নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এরপরে নারীবাদীরা নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ এর যুগে প্রবেশ করেন যেখানে সামাজিক ও সংস্কৃতিগত বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অসমতার বিষয়গুলো সামনে আসে।
বিংশ শতকের মধ্যভাগে এসেও দেখা যায় ইউরোপের অনেক দেশেই নারীরা কিছু গুরুত্বপূর্ন অধিকার অর্জন করতে পারেনি। এইসব দেশে তখনো নারীবাদীরা ভোটাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সুইজারল্যান্ডের নারীরা ১৯৭১ সালের ফেডারেই ইলেকশনে এসে ভোটাধিকার প্রাপ্ত হয়। লিশটেন্সটাইনে নারীদের ভোটাধিকার গণভোট–১৯৮৪ অনুষ্ঠিত হবার পরে নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়।
ভোটাধিকারের পাশাপাশি নারীবাদীরা পারিবারিক আইন সংশোধনের জন্য লড়াই করতে থাকে। যদিও বিংশ শতকের হাওয়া যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে লাগতে শুরু করে। তারপরেও নারীরা খুব কম অধিকারই চর্চা করতে পারছিলো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ফ্রান্সে বিবাহিত নারীদের ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাজে যোগদান করার অধিকার ছিলো না।
এছাড়াও নারীবাদীরা ধর্ষণ আইনে “বৈবাহিক অব্যাহতি” তুলে নেয়ার জন্য লড়াই করছিলেন। এ আন্দোলনকে নারীবাদের প্রথম ঢেউ এ ভল্টারাইন ডি ক্লেয়ার, ভিক্টোরিয়া উডহাল এবং এলিজাবেথ ক্লার্ক এলমি প্রমুখ নারীবাদীদের ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে অপরাধ হিসেবে আইন করার যে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিলো তার পরবর্তী ধাপ হিসেবে দেখা হয়, কেননা এ প্রয়াস উনিশ শতকে ব্যর্থ হয়েছিলো। এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র পশ্চিমা গুটিকয়েক দেশের নারীরাই এ অধিকার ভোগ করে, কিন্তু পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নারীদের এ অধিকার নেই।
ফরাসী দার্শনিক সিমোন দ্যা বোভোয়ার ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় লিঙ্গ বইয়ে নারীবাদের অনেক প্রশ্নের সমাধান মার্কসীয় অস্তিত্ববাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেন। এই বইটিতে তিনি নারীবাদীদের দৃষ্টিতে অন্যায় তুলে ধরেন। নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউকে ১৯৬০ এর দশকে শুরু হওয়া নারীবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় যা ভোটাধিকার পরবর্তী অন্যান্য অধিকার যেমন জেন্ডার অসমতা নিয়ে কাজ করে। এছাড়াও এসময় সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অসমতা দূরীকরণে কাজ করা হয়। নারীদের প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যাগুলো যে রাজনৈতিক এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট সে ধারণা প্রচার পায়। এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে সক্রিয় নারীবাদী এবং লেখিকা ক্যারল হ্যানিসচ ‘পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল’ কথাটি তুলে ধরেন যা পরবর্তীকালে নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ এর সমার্থক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
রুকসানা রহমান