মৌলবাদ হলাে কোনাে মতবাদের অবিকৃত মূলতত্ত্ব , যা অন্ধ বা গােড়ামিপূর্ণ বিশ্বাস । জঙ্গ বা জংগ থেকে জঙ্গী বা জঙ্গীবাদ । জংগ শব্দ মূলতঃ যুদ্ধ , লড়াই , তুমুল কলহ , প্রচণ্ড ঝগড়ার প্রতিশব্দ বা সামর্থক শব্দ । এই যুদ্ধ এবং দ্বন্দ্ব থেকেই জঙ্গীবাদের সৃষ্টি । মৌলবাদ থেকেই জঙ্গীবাদের উদ্ভব । এটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুইভাবেই প্রকাশ করা যায় । মৌলবাদ এবং জঙ্গীবাদের সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই । এটা নির্ভর করে পারস্পারিক দুই পক্ষের মানসিকতা , উদ্দেশ্য এবং ইচ্ছার উপর । আদিকাল থেকেই এর ধারাবাহিকতা চলে আসছে । আদিকালে মানুষ বিভিন্ন গােত্রে বিভক্ত ছিলাে । একটু শক্ত সামথ্য মানুষ এবং জীব অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতাে । বশ্যতা স্বীকার করানােই ছিলাে না তাদের মূল উদ্দেশ্য । বশ্যতা স্বীকার না করলে একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তাে । সহাবস্থানের নীতি সেখানে ছিলাে অচল । হয় বশ্যতা স্বীকার কর , না হয় মর । ‘ যারা মূল নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতাে তারাই হয়ে যেতাে জঙ্গী বা পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী । বিভিন্ন প্রচলিত ধর্মের ইতিহাস হয়তাে সেটাই বলবে । মূল ধর্মে বিশ্বাস না করলে তারা পথভ্রষ্ট । তাদেরকে কতল করাই ছিলাে চিরাচরিত বিধান । মৌলবাদ আর জঙ্গীবাদ সবকিছুর মুলে মূলতঃ আধিপত্য বিস্তার , শাসন , শােষণ এবং অন্যকে ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন । আদিমকালে ছিলাে শক্তিশালী গােত্রনেতা , সূচনাযুগে দেবদেবীদের শক্ত মানসিকতা এবং সন্মােহনী শক্তি , প্রচলিত রাজধর্মে ছিলাে পরাক্রমশালী রাজা বাদশা , জমিদারদের শােষন নিপিড়ন , সুফি – বাউলদের ছিলাে ভালােবাসা , সন্মোহনী শক্তি , বাকপটুতা । সবকিছুই ছিলাে আধিপত্য বিস্তারের কৌশল । মৌল শক্তি বিরােধীরা সেসময়ও বিদ্রোহী , বিপথগামী ভূষিত হতাে । ওই সময়ের বিরােধীরা অনেকেই নামকরা ডাকাত সর্দার , রাবণ বা অশুরের মতাে চরিত্রের ছিলাে । বর্তমান সভ্য সমাজে কিছু কিছু শব্দ খুব প্রচলিত , যার ভিত্তিতে মৌলবাদ , জঙ্গীবাদ , মানবতাবাদী , ফ্যাসীবাদী ইত্যাদি দ্বারা কোনাে মানুষ , গােত্র বা শ্রেণীর চরিত্র যাচাই করা হয় । তবে সবকিছুর মূলেই আধিপত্য বিস্তার । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় , বৃটিশ বিরােধী আন্দোলনে বৃটিশরা প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী বা পথভ্রষ্ট বা উগ্রবাদী বলতাে । বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে বুর্জোয়ারা আন্দোলনকারীদের বিপথগামী বলে । মৌলবাদ এবং জঙ্গীবাদের সুনির্দিষ্ট কোনাে সংজ্ঞা বা চরিত্র নেই । এটা নির্ভর করে বিদ্যমান দুই পক্ষের উদ্দেশ্য , স্বার্থ এবং অভিপ্রায়ের উপর । অবস্থানভেদে এবং ক্রিয়াকলাপভেদে এদের সংজ্ঞা এবং চরিত্র ভিন্ন হয় । জঙ্গীবাদ , মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদীদের মদদেই সৃষ্টি এবং তাদেরই স্বার্থে । মৌলবাদের সংজ্ঞা এবং মূলভেদে মৌলবাদ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে । ধর্মীয় মৌলবাদ , গােত্রীয় মৌলবাদ , সামাজিক মৌলবাদ , পারিবারিক মৌলবাদ , দলীয় মৌলবাদ , শাসকীয় মৌলবাদ ইত্যাদি । মূলতঃ মৌলবাদের চরিত্র প্রকাশ পাবে সংস্কারের পক্ষ বিপক্ষ দুইটি বিবদমান শক্তির অভিপ্রায়ের উপর । চাওয়া – পাওয়ার হিসেব মিলাতে গিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষকে বিপথগামী বা জঙ্গী বা শাসক বা নিপিড়নকারী বা সংস্কারবাদী এমনকি বর্তমানে প্রচলিত আস্তিক – নাস্তিক আখ্যা দিতে পারে । তবে সবকিছুর মুলে আধিপত্য , সংস্কার , ক্ষমতা এবং বৈষয়িক স্বার্থ , সর্বোপরি আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তার । সংস্কারের ভয় বা ক্ষমতা হারানাের ভয় বা ক্ষমতা দখলের এবং ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবল বাসনা থেকেই মূলতঃ মৌলবাদ , জঙ্গীবাদের সৃষ্টি । বলা যায় , বিষবৃক্ষের দুটি ডালে দুটি বিষাক্ত কাটা মৌলবাদ আর জঙ্গীবাদ । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুবিধা বিবেচনায় ইতিবাচক এবং নেতিবাচক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে । ক্ষমতা দখলে বেড়াতে হবে কেবল পুত্র সন্তানহীন বাবা – মায়েরাই ভেতরে ভেতরে অনুভব করেন । যে কারণে এখনও অনেক পরিবারই কন্যা সন্তানের জন্মকে স্বাগত জানাতে পারেন না । এর দায় কিন্তু আমাদেরও বহন করে বেড়াতে হবে । কারণ , একজন পুত্র সন্তান যেভাবে তার বাবা – মায়ের সংসারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেয় , আমরা নারীরা কিন্তু সেভাবে পালন করি না । সেসব দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে নারীরা । বুঝতে হবে , কন্যা সন্তানের বাবা – মায়েরাও কিন্তু অনেক কষ্ট করে , টাকা – পয়সা খরচ করে তাদের আদরের কন্যাটিকে মানুষ করেন । তারাও এক সময় বৃদ্ধ হয়ে যান , তাদেরও একটা আশ্রয় ৰা অবলম্বন দরকার হয় । এটাই বাস্তবতা যে , বাড়ি বা স্বামীর খবরদারির কারণেই , ইচ্ছে থাকার পরও নারীরা পারছে না তাদের মা – বাবার পরিবারের দায়িত্ব নিতে । সেই সুযােগটা কি আমরা নারীরাই তাদেরকে দিচ্ছি না ? কারণ , আমরা মেয়েরা এখনও স্বামীর কাছে শিশু হয়ে থাকতেই পছন্দ করি । মুখে মুখে আমরা পুরুষের সমান অধিকার চাই । কিন্তু বিয়ে করার সময় ঠিকই নিজের চেয়ে বয়সে বড় এবং অধিক যােগ্য পুরুষকেই বেছে নিই । যে মানুষটি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং আমার চেয়ে বেশি আয় করে , সে তাে চাইবেই আমি তার কথায় ওঠাবসা করি এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই পুরুষের পরিবার আমার ওপর খবরদারি করবে । একজন প্রতিষ্ঠিত পুরুষ অনায়াসে অল্প শিক্ষিত , বেকার নারীকে বিয়ে করে সংসার করছে । কিন্তু আমরা নারীরা কখনই কোনাে বেকার পুরুষকে বিয়ে করতে রাজি হই না । এখনও মেয়েরা চায় , স্বামীরা তাদের শাসন করুক । নিজের মাথার চুলটা পর্যন্ত স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাটতে চায় না তারা , পাছে স্বামী যদি আর তাকে পছন্দ না করে । আর নিজের চেয়ে বয়সে ছােট একজন পুরুষকে বিয়ে করা তাে এখনও আমাদের সমাজে একটা লজ্জার বিষয় । এই লজ্জা এমনভাবে আমাদের সমাজে ঢুকে গেছে যে , তা থেকে বেরিয়ে আশা যেনাে অসাধ্য একটি বিষয় । এমনকি ধর্মও আমাদের নারী সমাজের এই মানসিকতাকে বদলাতে পারছে না । আমরা মুখেমুখেই শুধু পুরুষের সমান অধিকার চাই কিন্তু পুরুষের মত করে সংসারের দায়িত্ব নিতে এখনও অনেক ভয় পাই আমরা । একজন উচ্চশিক্ষিত চাকুরীজীবী পুরুষ যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা তারও চেয়ে কম শিক্ষিত ও কম বয়সী নারীকে বিয়ে করে তার ভরণ – পােষণের দায়িত্ব নিচ্ছে , একজন উচ্চ শিক্ষিত চাকুরীজীবী নারীও যদি অল্প শিক্ষিত , কম বয়সী কোনাে বেকার পুরুষকে বিয়ে করে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নেয় , তবে স্বামীরাও নিশ্চয়ই স্ত্রীদের ময়লা কাপড় ধুয়ে দিবে , রান্না করে খাওয়াবে , এমনকি সন্তানেরও দেখাশুনাও করবে , চিরাচরিত এই সমাজে নারীরা করে থাকে । তখন নিশ্চয়ই স্বামীদের খবরদারি সহ্য করতে হবে না মেয়েদের । ইচ্ছে মতাে নিজের বাবা – মায়ের দেখভালও করতে পারবে তারা । কিন্তু কজন মেয়ে পারছে , জীবন নিয়ে এভাবে চিন্তা করতে ? একজন বেকার পুরুষকে বিয়ে করার সৎ সাহসই বা আছে ক ’ জন নারীর ? নারী বেকার থাকলে দোষ নেই । কিন্তু , এই সমাজে পুরুষের বেকারত্ব যেন একটি মহাপাপ । চরম নারীবাদীরাও হয়তাে মানতে পারেন না যে , তার স্বামীর কোনাে আয় নেই বা তার স্বামী বয়সে ছােট । আমরা কথায় কথায় পুরুষের দোষ খুঁজে বেড়াই কিন্তু নিজেদের দুর্বলতাগুলাে নিয়ে কখনই মুখ খুলি না । নারীবাদী হতে গিয়ে , আমরা অনেকটাই পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছি , যা আসলে আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শেখায় । বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যদি বেগম রােকেয়ার নাম আসে , তবে তার আগে আসা উচিৎ রােকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের এবং স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হােসেনের নাম । কারণ , সেই সময়ে মুসলমান সমাজে মেয়েদের ঘরের বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযােগ ছিলাে । । ফলে রােকেয়া স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখতে পারেননি । তার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের রােকেয়াকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, গভীর রাতে আলো জ্বালিয়ে, বিয়ের পর স্বামী সােখাওয়াত হোসেনের সাহায্যে মেয়েদের জন্য স্কুল খুলে ছিলেন।
॥ রুখসানা রহমান ॥