এককালে বাঙালী মুসলিম সমাজে ‘ হিল্লা বিয়ের প্রচলন ছিলাে ব্যাপকভাবেই । গ্রামীণ সমাজের কথিত মােল্লারা এই ঘৃণ্য ফতােয়াটি দিতাে সমাজপতিদের গােপন নির্দেশে । এক্ষেত্রে সমাজপতিদের উদ্দেশ্য ছিলাে ঘৃণ্য । ফতােয়াটির সাথে ইসলামের ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকলেও ইসলামী আইন হিসেবেই চালিয়ে দেয়া হতাে । ফলে সেসময় ইসলামের নামেই অগণিত নারী ‘ বৈধ ধর্ষণ ’ – এর শিকার হতাে । এটাকে বৈধ ধর্ষণ বললাম একারণে যে , বিবাহিত নারীকে ফতােয়ার মাধ্যমে অন্য কারাের সাথে বিয়ে দিয়েই তাকে ধর্ষণ করার সুযােগ করে দেয়া হতাে । হিল্লা বিয়ে দেয়া সম্ভব না হলে সংসার ভেঙ্গে যেতাে । বর্তমানে মানুষ বহুলাংশে সচেতন হওয়ায় গ্রামীণ মােল্লারা আর পেরে উঠছে না । প্রতিরােধের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের । গ্রামগুলােতে শিক্ষিতের হার বাড়াতে এবং অর্থনৈতিকভাবে গ্রামীণ মানুষগুলাে এগিয়ে যাওয়ায় সমাজপতিতের দৌরাত্বও এখন কমেছে বহুলাংশে । ফলে এখন ওই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত অনৈসলামিক ফতােয়াটির চল কমে গেছে । একেবারে যে বন্ধ হয়ে গেছে তা বলা যাবে না । সুযােগ পেলেই থাবা বিস্তার করে । দিনের ‘ রুটিং ওয়ার্ক হিসেবে পড়ছিলাম একটি দৈনিক সংবাদপত্র । একটি সংবাদ আমার দৃষ্টি কাড়ে । সংবাদটি বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া নামের একটি গ্রামের এক সাহসী নারীর । ১৯৯৮ সালে ওই গ্রামের সমাজপতি ও ফতােয়াবাজদের কথিত ‘ হিল্লা বিয়ের বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাহসী গৃহবধূ পারভীন বানু । কথিত মােল্লার মিথ্যা ফতােয়ার শিকার হয়ে তার দাম্পত্য জীবন কালাে মেঘ আচ্ছন্ন করে ফেলে । তার গােছানাে সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় । জীবন হয়ে উঠে কন্টকাকীর্ণ ও বিষময় । জীবনের সােনালী দিনগুলাে হারিয়ে যায় মহূর্তের মধ্যে । সেসময় সমাজের চাপে তার স্বামীও নীরব ছিলেন । অনেকটা বাধ্য হয়েই মেল্লাতান্ত্রিক সমাজ আর সমাজপতিদের মুখে পদাঘাত করেই একবছর বয়সী মেয়েশিশু মিনা আক্তার মিতুকে নিয়ে পারভীন চলে যান বাবার বাড়ি । এদিকে এ ঘটনার বিশ বছর পর চলতি বছর ওই মেয়ে কথিত ফতােয়ার বিষয় উড়িয়ে দিয়ে পিতৃত্বের অধিকার আদায় করে নেয় । বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের মিন্টু সােনারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলাে একই গ্রামের পারভীন বানুর । একবছর পর তাদের ঘরে জন্ম নেয় একটি মেয়েশিশু । নাম রাখা হয় মিনা আক্তার মিতু । একদিন দাম্পত্য কলহের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রীকে তালাক উচ্চারণ করেন স্বামী মিন্টু । পাশের বাড়ির লােকজন তা শুনে ফেলে । জানায় গ্রাম্য মাতবরদের । দাম্পত্য কলহ ছিলাে ক্ষণিকের । মান – অভিমান দূরও হয়ে যায় দ্রুত । তারপরও গ্রামীণ অশিক্ষিত মাতবর ও মুন্শী – মৌলভীদের ফতােয়ার হুঙ্কার – পারভিন বানুকে হিল্লা বিয়ে দিলে সংসার করা যাবে না । যদি হিল্লা বিয়ে না করে তাহলে তাকে সমাজচ্যুত করা হবে । দরকার হলে করা হবে গ্রাম ছাড়া । মিন্টু সােনার সমাজপতিদের ভয়ে বাধ্য হন নীরব থাকেন । তার নীরবতাকে কাপুরুষচিত মনে করে পারভীন বানু ফতােয়াবাজদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন – কিসের ফতােয়া ! রাগের মাথায় স্বামী তালাক উচ্চারণ করলেই তা কার্যকর হয়ে যায় না । তালাকের আইনগত প্রক্রিয়া আছে । আর হিল্লা বিয়ে অপরাধ । ইসলাম ধর্মের সাথে এর কোনাে সম্পর্কও নেই । পারভীন বানুর এই প্রতিবাদ কোন কাজে আসেনি সেসময় । গ্রামের লােকজনও তার পাশে দাঁড়ায়নি ধর্ম যাওয়ার ভয়ে ! ঈমান হারানাের ভয়ে !পারভীন বানু ওইদিনই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে চলে যান । পিতার স্নেহবঞ্চিত হয়ে মিতু বেড়ে ওঠে মায়ের মমতা এবং নানা আশরাফ মন্ডল ও নানী রাহেলা বেগমের আদরে । পারভীন বানু হাঁস – মুরগি , গরু – ছাগল পালন করে মেয়েকে লেখাপড়া শেখান । মিতু এরুলিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও জাহেদুর রহমান মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয় । সেবার ব্রত নিয়ে সে এবছর বগুড়া টিএমএসএস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্স এ্যান্ড টেকনােলজিতে নার্সিং ডিপ্লোমা ১ম বর্ষে ভর্তি হয় । তারপর লেখাপড়ার খরচ নিয়ে ভাবনায় পড়েন মা – মেয়ে । ওদিকে পারভীন বানুর স্বামী মন্টুও খোঁজখবর রাখেনি স্ত্রী ও মেয়ের । উল্টো সে আরেকটি বিয়ে করে । মিতু একদিন টিএমএসএসের বিভিন্ন কার্যক্রম অবগত হয় । সহযােগিতা চেয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে তার মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া পুরনাে ঘটনাটি জানায় । বিস্তারিত শুনে টিএমএসএসের মানবাধিকার বিভাগ এগিয়ে আসে । তারা একটি সামাজিক বৈঠকের আয়ােজন করে । সালিশের মধ্যস্থতায় পিতা মিন্টু সােনার তার মেয়ে মিনা আক্তার মিতুর শিক্ষার ব্যয়বহনের অঙ্গীকার এবং মেয়ের অধিকার ফিরিয়ে দেন । বললেন , বুকের ভেতরের জমে থাকা বেদনা দূর হলাে । বাবা ও মেয়ের মিলনের সাক্ষী হলেন মিতুর চাচা , নিকট আত্মীয় , টিএমএসএস ’ র পরামর্শক ও সাবেক যুগ্ম – সচিব নাজমুল হক , পরিচালক আব্দুস সালাম , জনসংযােগ কর্মকর্তা রায়হান আহমেদ রানা , সহকারী জোনাল ম্যানেজার শাহানা আফরােজ । টিএমএসএস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্স এ্যান্ড টেকনােলজি নামের প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম লক্ষ্য , সমাজের সকল কুসংস্কার দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা । এই প্রতিষ্ঠানটি ফতােয়াবাজদের মুখে চুলকালি মাখিয়ে আদায় করে দিলাে নারীর অধিকার । দেশের প্রতিটি জেলায় এধরণের একটি করে প্রতিষ্ঠান সরকারী উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠা করা দরকার । যাতে করে সমাজ কুসংস্কার মুক্ত হয় । ধর্মের নামে নারী নির্যাতন রােধ করা যায় । কথিত মােল্লা আর বাতিকগ্রস্থ সমাজপতিরা ধর্মের নামে যেনাে নারীদের শিকারে পরিণত করতে না পারে । সাথে সাথে নারীরা যাতে পারে তাদের স্বীয় ন্যায্য অধিকার আদায়ে সক্ষমতা অর্জন করতে ।
রুকসানা রহমান