ধর্মান্ধতা মুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি সমাজের জন্য আমার লড়াই •••••••••• . রুকসানা রহমান ।
নারীবাদী লেখিকা রুকসানা রহমান জন্মেছেন এক বুনিয়াদী সাংস্কৃতিমনা পরিবারে । এই পরিমন্ডলেই তিনি বেড়ে উঠেছেন । কাটিয়েছেন জীবনের একটি বড় অংশ । বাবা খান আরিফুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের একজন স্বনামধন্য চিত্রগ্রাহক এবং বিএফডিসি ’ র প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন হরেন । মা রওশন আরা বেগম ছিলেন মঞ্চ ও সিনেমা জগতের নামকরা অভিনেত্রী । চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী খান আতাউর রহমানের ভাতিজি তিনি । পঞ্চাশ দশকের কিংবদন্তী গায়িকা মাহবুবা রহমান তার চাচী । জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনও তাৱ চাচী । তার স্বামী দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন । পারিবারিক জীবনে তিনি এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জননী । জীবনের শুরু থেকেই বাঙ্গালী সংস্কৃতিকেই আলিঙ্গন করেছেন এই নারীবাদী লেখিকা রুকসানা রহমান । ছােটবেলা থেকেই ঘৃণা করতে শিখেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার , ধর্মান্ধতা , ধর্মীয় উন্মাদনা , মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে । মনে – প্রাণে লালন করেছেন নারী – পুরুষের সমতা ও নারীর অধিকারকে । তিনি সর্বদাই সােচ্চার থেকেছেন নারী নিগ্রহতা, নারী নির্যাতন , নিষ্পেষনের বিরুদ্ধে । ছােটবেলা থেকেই মুক্তমনা ও স্বাধীনচেতা এই নারীবাদী লেখিকা লিখে চলেছেন ধর্মীয় উন্মাদনা , ধর্মের নামে স্বেচ্ছাচারী পীরতন্ত্র ও কথিত পীরের মাজারে সংঘটিত ভন্ডামি বিরুদ্ধে । লিখছেন ধর্মান্ধতার আধুনিক সংস্করণ জঙ্গীবাদের _ বিরুদ্ধে । তার এই বিষয়ধর্মী লেখাগুলাে মাঝে – মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে । লেখাগুলাে প্রকাশিত হওয়ায় বহুবারই তিনি বিভিন্ন ধর্মান্ধগােষ্ঠীর হুমকীর শিকার হয়েছেন । তবুও ছেদ পড়েনি তার লেখনীতে । সম্প্রতি এক আনন্দঘন পরিবেশে দৈনিক সােনালী খবৱকে দেয়া সাক্ষাকারে তিনি যা বলেছেন তার কিয়দাংশ পাঠক সমীপে উপস্থাপিত হলাে ।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক সােনালী খৰৱেৱ উপ – সম্পাদক এম রইচ মল্লিক ।
সােনালী খবর : কেমন আছেন ?
রুকসানা রহমান : ভালাে , আপনী ?
সােনালী খবর : ভালাে । আর দশজন বাঙালী নারীর মতাে আটপৌরে জীবনকে উপেক্ষা করে লেখালেখিতে মন দিলেন কেনাে ? |
রুকসানা রহমান : দেখেন , আমি জন্মেছি একটি সাংস্কৃতিক পরিবারে । ওই পরিমন্ডলেই আমি কাটিয়েছি আমার শৈশব – কৈশোর ও যৌবনের একটি অংশ । একটু বুদ্ধি হতেই দেখেছি আমার পরিবারটি বাঙালি সাংস্কৃতি ও কৃষ্টি কীভাবে লালন করছে । আমিও ধীরে ধীরে তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছি । নিজস্ব সাংস্কৃতি আগলিয়ে ধরতে শিখেছি । আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি পুরুষের অবজ্ঞা , নারীকে স্বীয় অধিকারহরণে সামাজিক প্রবণতা , নারীর প্রতি বৈষম্য , ধর্মের নামে নারীর নিগ্রহতা আমাকে পীড়া দিতাে সেই ছােটবেলা থেকেই । ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকি সমান্তরালভাবে এই পীড়াটাও বৃদ্ধি পেতে থাকে । ছোটবেলা থেকেই আমার মনের মধ্যে এ সংক্রান্তে একটা জিজ্ঞাসার জন্ম নেয় । ভাবতাম , বড় হয়ে যদি সুযোগ পাই, তাহলে আমি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করবাে । ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থা নেবাে , সংগ্রাম করবাে । সেই চিন্তা – চেতনা থেকেই আমার লেখালেখি । লেখালেখিকেই আমার এই সংগ্রামের রণকৌশল হিসেবে নিয়েছি ।
সােনালী খবর : আপনার লেখার প্রধান বিষয়গুলাে কী ?
রুকসানা রহমান :আমি মূলতঃ নারী – পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী । আমি মনে করি , যে কাজটি একজন পুরুষ করতে পারে , সেই কাজটি একজন নারীও করতে সক্ষম । তাহলে কােনাে নারী বৈষম্যের শিকার হবে । আমি আমার লেখনীর মাধ্যমে তা তুলে ধরার চেষ্টা করি । এছাড়াও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে রয়েছে আমার দৃঢ় অবস্থান । আজ সারা বিশ্বই এক অশান্ত পরিবেশের মধ্যে নিমজ্জিত । এর মূল কারণই ধর্মীয় উম্মাদনা তথা জঙ্গীবাদ । বিশ্বের যেখানেই জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে , সেখানেই অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে । সভ্যতা কলুষিত হয়েছে , ধ্বংস হয়ে গেছে । বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের মাজারগুলাের অবস্থা দেখেন । ধর্মের নামে সে সব স্থানে হচ্ছেটা কী ? মাজারগুলোতে বেহেল্লাপনা , গাজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন , সাথে পতিতা ব্যবসা । এগুলাে চলছে ধর্মের নামে । এগুলােই আমার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় ।
সােনালী খবর : জঙ্গীবাদ তাে এখন বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের বিষয় । জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আপনী তো লিখছেন, ওই অপশক্তি থেকে কখনাে কী হুমকীর সম্মুখীন হয়েছেন ?
রুকসানা রহমান : অপশক্তি বিরুদ্ধে এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অংশ নিলে তো হুমকী আসতেই পারে । দেখেন , যেখানেই জঙ্গীদের উথান হয়েছে , সেখানেই সভ্যতার পতন হয়েছে । আফগনিস্তানের দিকে তাকান , দেশটির অবস্থাটা কি ? ধ্বংস হয়ে গেছে । ওসামা বিন লাদেন ও তার সৃষ্ট তালেবানরা দেশটাকে নরকে পরিণত করেছে । ধর্মের নামে সেখানে নারীকে যে অবস্থা করা হয়েছে , তা সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না । সেখানে নারী মানে ঘরবদ্ধ একটা জীব । একমাত্র যৌনকাজে আর বছর বছর সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া তাদের কোনাে ভূমিকা নেই । এক কথায় , নারী পুরুষের ভােগ্যপণ্য ছাড়া তারা আর কিছুই না । আফ্রিকার দেশগুলাের দিকে তাকান । সেখানে বােকো হারাম নামের ইসলামী জঙ্গীগােষ্ঠী সক্রিয় । দলে দলে নারী অপহরণ করা ছাড়া তাদের যেনাে আর কোনাে কাজ নেই । নারীদেরকে আটকিয়ে রেখে যৌনদাসীতে পরিণত করে ভােগের মাধ্যমেই গােষ্ঠীটি ইসলাম কায়েম করতে ঢাকায় । আমাদের দেশে রয়েছে বেশ কয়েকটি জঙ্গীগােষ্ঠী । তারা একযােগে দেশের ৬৩টি জেলায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । প্রেক্ষাগৃহে বােমাহামলা করেছে । আদালতে বোমাহামলা চালিয়েছে । অন্য ধর্মলম্বিদের উপাশনালয় ভুলিয়েছে , ভাঙ্গচুর করেছে , মানুষ হত্যা করেছে । হলি আর্টিজনে হামলা চালিয়ে দেশি বিদেশী অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। বেছে বেছে ব্লগার হত্যায় মেতেছে । ভারতে বােমাহামলা করেছে । ফ্রান্সে হামলা চালিয়েছে । পাকিস্তানেও নামাজরত অবস্থায় মসজিদে বোমাহামলা চালিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেছে । এদের বিরুদ্ধে কলম ধৱলে হুমকী তাে আসবেই । ওই অশুভ গােষ্ঠীগুলাে থেকে আমার অগণিতৰাৱ হুমকী এসেছে ।ওসব হুমকী অগ্রাহ করেই লেখালেখির মাধ্যমেই তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি । এটাকে আমি মানুষ হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবেই মনে করি ।
সােলালী খবর : আপনী একজন নারীবাদী লেখিকা । নারী জাগরণ ও নারী মুক্তিই আপনার প্রত্যাশা হওয়া উচিৎ । তাহলে আপনী কেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে কলম ধরে থাকেন ?
রুকসানা রহমান : আদিকালে যখন মানুষসভ্যতা প্রতিষ্ঠা পায়নি , তখন কিন্তু নারীতান্ত্রীক সমাজব্যবস্থা ছিলাে । নারীদের একাধীক পুরুষ বেষ্টিত থাকতে হতাে । কালের পরিক্রমায় কিছুটা সভ্যতা আসলে বিবাহের বিষয়টি সামনে আসে । তখন কিন্তু নারীর বহু বিবাহের প্রচলন ছিলাে । তখনও নারীই ছিলাে । পরিবারের মুখ্য ব্যক্তি । কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে নারীকেই গর্ভধারণ করতে হয় । একাধিক স্বামী থাকার কারণে সন্তানের পরিচয় নিশ্চিত হতাে মায়ের পরিচয়ে । তারপর সভ্যতা প্রতিষ্ঠালাভের সাথে সাথে নারীর অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সূত্রপাত ঘটে । এখানেই আমার প্রশ্ন , নারীর অধিকার খর্ব করা কেন , সমতাই বা করা হলাে না কেন ? করা হলাে , একেবারেই অধিকারহারা ! আমি কিন্তু পুরুষ বিদ্বেষী নই , আমি নারী – পুরুষের সমতায়ই বিশ্বাসী । এটা আমার চিন্তা – চেতনা জুড়েই রয়েছে ।
সােনালী খবর : মূলতঃ আপনার লক্ষ্যটা কী ?
রুকসানা রহমান :আমি এমন এক সমাজ ব্যবস্থার জন্য লড়াই করছি , যে সমাজ হবে সম্পূর্ণভাবেই বৈষম্যহীন । নারী – পুরুষ সমমর্যাদার অধিকারী হবে । কখনােই নারী হবে না তার ন্যায্য অধিকার থেকে বাধত । হবে না সমাজের করুণা আর অবহেলার শিকার । শিকার হবে না নির্যাতন , নিষ্পেষণ , নিগ্রহের । সমাজ হবে সম্পূর্ণরূপে কুসংস্কার আর ধর্মান্ধের কালাে থাবা মুক্ত ।
সােনালী খবর : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
রুকসানা রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ ।
২৫শে জুন ২০১৮