বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবস্থা দেখলে শঙ্কা হয়, দিন দিন আমরা যেন পিছু হটছি। শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বের মুসলমান সমাজের অবস্থা দেখলেও শঙ্কিত, ক্ষুব্ধ হতে হয়। আমার মনে হয় দুটি কারণ এই অবস্থার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। কোন মতাদর্শ তার আপন মাহাত্মে মানুষকে কাছে টানতে পারে, আবার সংঘবদ্ধ, আর্থিক সহায়তাপুষ্ট তৎপরতাও কোন মতাদর্শকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে।
অর্ধশতাব্দীরও আগে থেকে যখন তৃতীয় বিশ্বে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়, তখন আর্থসামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়, তার ঢেঊ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম সমাজেও অনুভূত হয়। সেখানে ইসলামী ধর্মান্ধতা নয়, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তার অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি, এবং পরাধীনতার শোষণ ও অপমানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এসব ঐহিক চিন্তাভাবনাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আলজেরিয়ার Ben Bella, তিউনিসিয়ার Habib Bourguiba, মিসরের Gamal Nasser, PLO-এর Yasser Arafat, George Habash এরা এই বৌদ্ধিক আন্দোলনের ফল। আমাদের উপমহাদেশে শীর্ষ উর্দু কবিরা –পাকিস্তানের Faiz Ahmad Faiz, Ahmad Faraz, ভারতের Kaifi Azmi তো রীতিমত কমিউনিস্ট–ঘেঁষা ছিলেন।
কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে বিভিন্ন দেশের আজ মুসলিম সমাজে এই নেতৃত্বের প্রতি এবং সেই সাথে এই মতাদর্শের ব্যাপারে সুবিশাল মোহভঙ্গ ঘটেছে। দেখা গেল, স্বাধীনতার সময় যেসব নেতারা অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিয়েছে, পরে তারাই সমাজের সকল আর্থসামাজিক সুযোগ সুবিধা কুক্ষিগত করল, অত্যাচারী দুর্নীতিগ্রস্ত শোষক হয়ে উঠল, কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শক্তির চাইতেও ভয়াবহ হয়ে উঠল। Hamas আর Muslim Brotherhoodকে যত গালই দাও না [আমিও দিই], ওরা আপামর জনমানুষের সাথে বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষের সাথে যেভাবে মিশে গিয়েছে, সেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেই তুরস্কে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কামাল আতাতুর্ক ঠেঙিয়ে খিলাফত বিতাড়িত করেছে [উপমহাদেশের অর্বাচীন মুসলিম সমাজ এই প্রতিক্রিয়াশীল খিলাফতের সপক্ষে আন্দোলন করেছে!], আজ Recip Erdogan-এর ইসলামপন্থী দল সেখানে মহাপরাক্রমে শাসন করছে, এটা সম্ভব হয়েছে কারণ দলটির সর্বস্তরের মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা আছে। [এই দল ইসলামপন্থী হলেও অনেকট pragmatic, তালেবানের মত বর্বর নয়।]
প্রগতিশীল, উদার মানবিক, rational বা বামপন্থী চেতনা, আমার মতে, বাংলাদেশে তো বটেই, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সমস্যা হলো, এই গোষ্ঠীর বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সঙ্গতভাবেই কম। আমরা হলাম সবাই armchair revolutionary, আমাদের দৌড় ড্রয়িং রুমে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলা পর্যন্তই। মার্ক্সবাদে আমার কখনোই নিরঙ্কুশ আস্থা ছিলনা, কিন্তু ‘সবার ওপর শ্রেণী সত্য’ – মার্ক্সের এই আপ্তবাক্য আমার মর্মান্তিক সত্যি মনে হয়।
এই রন্ধ্রপথে নানাভাবে ইসলামী মৌলবাদের অনুপ্রবেশ। আরব বিশ্বের ইসলামপ্রীতি সহজাত, তবে সর্বত্র এটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বিশেষত আরব বিশ্বের বাইরে সৌদী Salafiদের মদদে নানান দেশে এই বর্বর, হিংস্র, নারীবিরোধী, পরধর্মবিদ্বেষী মতাদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিম সমাজের সর্বনাশ করেছে। শুধু বাংলাদেশ কেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এই করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি।
[অসমাপ্ত]
সংগ্রিহীত