হাইকোর্টের মাজার চিনেন না বা নাম শুনেননি এমন লােক খুব কমই আছে এদেশে । এই গানটির সাথেও রয়েছে অনেকের পরিচয় – ‘ হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে রে , কয়জনা আসল ফকির । ‘ হাইকোর্ট মাজারে আরাে শােনা যায় , “ যদি এসে থাকো দয়াল তরাতে কাঙ্গাল ( দয়াল ) আমারে নিয়ে পার করিয়া ॥ ( আমি ) নামাজ তাে পড়ি না রােজা তাে রাখি না পার করে দাও দয়া করিয়া ॥ আমি ভবেতে আসিয়া মায়াজালে পড়িয়া গিয়াছি তােমাকে ভুলিয়া ॥ ও দয়াল আমারে নিয়ে পার করিয়া ॥ ” হাইকোর্ট মাজারের আসরে প্রায় উপস্থিত থাকে , কাঁচপুরের বাউল পাগল সুরুজ । সে ঢাকা শহরের সব মাজারগুলােই চিনে , কোন মাজারে কবে গান হয় তাও তার মুখস্থ । মাজারে মাজারে গান করে বেড়ায় সে । ঢাকা শহরের অধিকাংশ মাজারেই গানের আসর বসে প্রতি বৃহস্পতিবার । দু – একটি মাজারে বৃহস্পতিবার ও রবিবারে গানের আসর হয় । ঢাকা শহরে সব থেকে বড় মাজার চত্বর মিরপুর ১ – এ , শাহ আলীর মাজার । শাহ আলীর মাজারে গেলে এই গানটি শুনা যাবেই । “ আল্লা নবীর নাম লইয়া আসরেতে দাঁড়াইলাম । বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম ॥ প্রথমে বন্দনা গাে টানি মক্কাতে লইলেন জন্ম মুহাম্মদ নবী । হযরত আলী মা ফাতেমা । ইমাম হুসেন যাহার নাম । বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম ॥ ” ওই মাজারে এক কিশােরী কন্ঠে তার পীর বাবার সাজানাে আস্তানার সামনে এই গান গেয়ে থাকে । তার সঙ্গে দোহারকি করে অন্য তিন কিশােরী । তাদের কারাে হাতে হারমােনিয়াম , কারাে হাতে মন্দিরা এবং কাঠজুড়ি । ঢােলবাদনে থাকে একজন তরুণ পুরুষ । দেখা যাবে , গানের ওই আসরের সামনে ভিড় করে আছে মাজারে ( কবরে ) শায়িত পীরের ভক্তরা । তবে ওখানে গানের আসর বসে অনেকগুলাে । মেয়েশিশুরাও ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে গান গায় । “ খাজাবাবা খাজাবাবা মারহাবা মারহাবা , গেয়েছিলাে নবীর গুণগান ॥ ” সুরেলা নারীকণ্ঠে শুনা যাবে , জিকিরের আদলে তােলা সুরে গান “ আমার শাহ আলী বাবার লীলাখেলা দেখবি যদি আয় ।আমার মাইজভাণ্ডারীর লীলাখেলা দেখবি যদি আয় । আয় , দমে দমে মাইজভাণ্ডারীর লীলা দেখা যায় । আয় , দমে দমে আলী বাবার লীলা দেখা যায় ॥ ” এইসব আসরে নারী – নরে কোনাে ভেদাভেদ নেই । এইখানে সুরে সুরে পীরের প্রেমভক্তি । কোনাে আসরে সকলে মিলে বাদ্যবাদনে , দোহারকিতে প্রেম – ভক্তি যােগে গাইতে থাকে “ আমার মন মজাইয়া রে দেল মজাইয়া তুমি কোন দেশেতে যাও । একে আমার ভাঙা নাও তার উপরে তুফান বাও ছলকে ছলকে ওঠে পানি রে ॥ সবার আছে জায়গাজমি টাকা পয়সার নাই কমি । আমার মাঝে আছাে বাজান তুমি রে জীবনে মরণে ঠাই দিও সঁই চরণে । তুমি বিনে আর কারাে নাম জানিনে । আমার মন মজাইয়া রে দেল মজাইয়া তুমি কোন দেশেতে যাও ॥ ” মাজারভক্তরা ঢােল , হারমােনিয়াম , মন্দিরা , কাঠজুড়ির দমকে দমকে আকুল হয়ে জিকিরের মতাে করে গানগুলাে গেয়ে থাকে । “ তােমার রওজায় এসেছি । খালি হাতে যাবাে না৷ আশা পূরণ করে দাও শাহ আলী নিরাশ করাে না । আমি গুনাগার ভরসা তুমার চরণছাড়া করাে না । আশা পূরণ করে দাও খালি হাতে যাবাে না ॥ ” এ আবার কেমন দাবি ‘ খালি হাতে যাবাে না । কার কাছেই বা দাবী করছে ? । মিরপুরে শাহ আলী কিংবা হাইকোর্টে শরফুদ্দিনের মাজারে সবখানেই এই একই গানের – সুরের – কথার গান চলতেই থাকে । পীরের মাজার । বলা হয় , পীররা ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক । ওই ধর্মপ্রচারকরা নিশ্চয় ডুগি – তবলা , ঢােল – কাসারী নিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ধর্ম প্রচার করতেন না । তারা কী বলে গেছেন , তাদের মৃত্যুর পর তার কবরকে মাজার বানিয়ে নারী – পুরুষ মিলে গান – বাজনা করতে ? কোনাে ধর্মীয় অথবা ইতিহসে এমন তথ্য পাওয়া যায় না । তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে , পীরের মাজার বানিয়ে আগরবাতি , মােমবাতি ও নাচ গানের এই সংস্কৃতি তখন থেকে চালু হয়েছে আর চালু করলােই বা কারা ? একটু নজর দিলেই আমাদের দেশের অধিকাংশ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পাশেই একটি না একটি মাজারের অবস্থান পাওয়া যাবে । বঙ্গভবন থেকে শুরু করে হাইকোর্ট , ঢাকা মেডিকেল কলেজ , ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ( পুরাতন ) , এফডিসি , ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট , এমনকি বাংলা একাডেমী ও বাংলাদেশ পরামাণু শক্তি কমিশনের কোল ঘেঁষেই পীর – দরবেশদের মাজার রয়েছে । প্রশ্ন আসতেই পারে , বেছে বেছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলাের কোলঘেষে কেননা মাজারগুলাে গড়ে উঠলাে ? এর পাশাপাশি আরাে কিছু প্রশ্ন আসতেইপারে – মাজারগুলাে প্রতিষ্ঠার পিছনে এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলাের প্রতি পীরের কোনাে আধ্যাত্মিক নির্দেশ ছিলাে কী ? নাকি প্রতিষ্ঠানের পাশে পড়ে থাকা সরকারী জমির উপর মাজার প্রতিষ্ঠা এদেশের কথিত ভাববাদীদের জন্যে সহজতর একটি উপায় ? এদেশের আদালত , জেলখানা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান , জ্ঞান – বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র , এমনকি চলচ্চিত্রশিল্পের কারখানা পর্যন্ত কেনাে মাজার থেকে দূরে নয় ? এই সকল মাজারে প্রতিবছর নিয়ম করে বাৎসরিক ঔরস ঘটা করে পালিত হয় । প্রতি বৃহস্পতিবারের গান – বাজনা , গাঁজা সেবন করে , মদ্যপান করে মাজারভক্তরা । মাজারের আশেকানদের আনন্দের আয়ােজন চলে এভাবেই । শাহ আলী ও শরফুদ্দিনের মাজারে মাঝে – মধ্যে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান হয় । অনুষ্ঠানগুলােতে ব্যান্ডপার্টিতে বেজে উঠে ক্ল্যারিনেট , ড্রাম , ঝাঝ । তাদের সুরবাদ্যের সঙ্গে শুরু হয় নৃত্য ও জিকির । ইসলাম ধর্ম চর্চার এই রূপ আগে আমরা বা আমার পূর্ব পুরুষরা হয়তাে দেখেনি । হাইকোর্টের মাজার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের তেলশাহর মাজারে প্রাতিষ্ঠানিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট । ওই সব জায়গায় যেসব গান হয় তা শুনে অনেকেই বিব্রত হন । এক সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই ছিলাে তেলশাহের মাজারের হর্তাকর্তা । পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার বালুরঘাটের নেজামী চিশতীর মাজার রয়েছে । নেজাম চিশতীর সন্তান বায়েজীদ চিশতী ওই মাজারের প্রধান ব্যক্তি । সেখানে রয়েছে তার খাসমহল । বাৎসরিক ওরসে সেখানে গানের আসর বসে । মাজারের রয়েছে অনেক ভক্ত । মাজারগুলােতে যেসব গান হয় তার অধিকাংশই প্রেমের । এই ধরনের একটি গান “ আমার কথা রেখেছি তােমায় ভালােবেসেছি তুমার সাথে ভালােবাইসা হয়েছি উদাসী ॥ তুমি যে আমার হায়গাে আমি যে তুমার আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যেয়াে না । আমি যে কে তুমার সেকি জানাে না । চাই না টাকা চাই না ধন চাই না জমিদারি তুমার সাথে ভালােরে বাইসা হইবাে ভিখারি ॥ ”
রুকসানা রহমান