ভাইয়া কাঁদছেন! আমার তিপান্ন বছর বয়সী ভাইয়া দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মত কাঁদছেন। ভাইয়ার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, আমার ইচ্ছে করছে ভাইয়ার মাথায় একটা হাত রাখি কিন্তু পারছি না। কী এক সংকোচে হাত সরিয়ে নিচ্ছি।
আমি পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে ভাইয়ার কাছাকাছি বসলাম। ভাইয়া কান্না থামিয়ে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন,
-স্বর্ণা এসেছিস?
বারান্দার আবছা আলোতে আমি একজন পরাজিত পিতার অস্পষ্ট মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। আমার ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে জয়ীতা আজ সকালে এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে! বেলা বারটার দিকে ফোন করে জানিয়েছে সে আর আহানাফ বিয়ে করে ফেলেছে। তারপর থেকে তাদের ফোন বন্ধ। দু’বাড়ির খেলা জমে গেছে সাপ আর বেজীর খেলার মত!
বিকেল তিনটায় ভাবী আধমরা মানুষের মত গলা করে ফোনে আমাকে জানালো,
-স্বর্ণা একটু বাসায় আসতে পারবি?
-আজই, ভাবী?
-হুম।
-কোন সমস্যা হয়েছে?
-বাসায় আয়, কথা আছে।
-আচ্ছা,হীয়াকে কোচিং থেকে নিয়ে, বাসায় রেখে আমি আসছি, ভাবী।
হীয়া আমার সতেরো বছরের মেয়ে। এ বছর এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেবে। লেখাপড়ায় ছোটবেলা থেকেই বেশ মনযোগী। প্রতিবার পরীক্ষার রেজাল্ট কার্ড দেখে তার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে তীর্যক হাসি হেসে বলেন, “আমার মেয়ে বলে কথা!” অথচ কোনদিন মেয়ের পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে একটু দাড়ানোর সময় হয়না যার। নিজের ব্যাবসা-বানিজ্য, নিজের জগতে বড্ড ব্যস্ত সময় তার। মাস পড়লে সংসার আর মেয়ের পড়ালেখার খরচটা আমার কাছে দিয়ে সব ঝামেলার অবসান যেন। এভাবেই চলে আসছে কুড়ি বছর।
মেয়েকে বাসায় নামিয়ে বের হবো এমন সময় ফয়সাল ঘরে ঢুকলো।
-কী ব্যাপার কোথাও যাচ্ছো?
-হুম, ভাইয়ার বাসায়।
-দু’দিন পর পর সেখানে কী?
-কী আর করবো বলো? বাপ-মা তো নেই, তাই মাঝেমধ্যে একটু ভাইয়ের বাসায় যাই।
-কখন ফিরবে?
-চলে আসবো দশটার মধ্যে।
-গাড়ী নিয়ে যাও। পৌছে গাড়ী পাঠিয়ে দিও। আমাকে নয়টার মধ্যে বের হতে হবে। আর ফিরতে রাত হবে।
-এ আর নতুন কী?
-কেন, নতুন কিছু দেখতে ইচ্ছে করে নাকি? জীবনটা তো আরাম কেদারায় বসে কাটিয়ে দিলে, বুঝতেও পারলে না কত ধানে কতটা চাল হয়!
-আর বুঝে করবো কী? আমি আসি। তুমি বরং ধান,চালের হিসেবটা একাই করো।
ভাবীর মুখে যা শুনলাম, তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেঁদে দু’চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ভাবী।
-আমরা একটুও বুঝতে পারিনি রে, স্বর্ণা। ওর বাবার কথাটা তো ভাবতে পারতো। সমাজে আমরা মুখ দেখাবো কিভাবে বল?
-সমাজ কী ভাবী? তোমরা সমাজ নিয়ে কেন ভাবছো? জয়ীতা নিরাপদে আছে কিনা সেটা ভেবেছো?
-ওকে নিয়ে কেন ভাববো? ও কি আমাদের কথা ভাবলো?
-তোমাদের কথা ভাবলে তোমরা কী করতে? তাহামিদের সাথে বিয়ে দিতে? জয়ীতা আর তাহামিদের তিন বছরের রিলেশন, এটা তো আমরা জানতাম, ভাবী। গতবছর থেকে জয়ীতা বিয়ের কথা বলছে, এমনকি তাহামিদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠালো! তোমরা কী করলে? তোমাদের দম্ভ আর অহঙ্কারে সব তুচ্ছ করে ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দিলে না।
-আমার কী দোষ!! তোর ভাইয়ার মুখের কাছে টেকা যায়? চিনিস না নিজের ভাইকে। বংশীয়ান ঘরের ছেলে ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেবে না। নিজেদের বিরাট বংশ! নদীর জল ঘোলাও ভালো, কত ডায়লগ! এখন তো পড়ে পড়ে কাঁদছে! নদীর সেই ঘোলা জলে এখন ডুবে মরা ছাড়া উপায় নেই!
-ভেঙে পড়ে লাভ নেই। এখন সবাইকে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভাবী।
-এসব কথা তোর ভাইয়াকে বল গিয়ে।
ভাইয়ার সাথে ঠিকক কিভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছি না। আমি চুপচাপ বসে আছি। এভাবে ভাইয়াকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন এক চাপ ধরা অনুভুতি হচ্ছে। ধরে আসা গলায় ভাইয়া বললেন,
-মেয়েটা এতো বোকামী করবে বুঝতে পারিনি রে!
-যা হবার তা তো হয়েই গেছে, ভাইয়া। এখন কিভাবে পরিস্থিতি সামলে নেবে তা নিয়ে দুই পরিবার আলাপ করো। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে ওদেরকে মেনে নাও, আর দোয়া করো, ওরা যেন ভাল থাকে।
-তুই কী বলছিস, স্বর্ণ? তুই সেদিনও বোকা ছিলি, আজও বোকায় থেকে গেছিস। নইলে এই কঠিন ব্যাপারটা নিয়ে এতো সহজ জ্ঞান দিতে আসিস?
-হ্যা ভাইয়া, আমি সেদিনও বোকা ছিলাম, আজও বোকায় আছি। ভাগ্যিস জয়ীতা আমার মত হয়নি!
-মানে?
-মানে যার সাথে সারাজীবন কাটাবে তাকে নিজে পছন্দ করে নিয়ে ভালই করেছে। আল্লাহ্ না করুন খারাপ কিছু হলে অন্ততঃ কাউকে দায়ী তো করতে পারবে না!
-তাই বলে বাবা-মা, বংশের মুখে কালি দিয়ে কাউকে সুখী হতে দেখেছিস তুই?
-বাবা-মা, বংশের মুখে চন্দনের প্রলেপ দিয়েও তো অনেকে সুখী হয় না, ভাইয়া!
-তুই সুখী হতে পারিসনি? এতো ধন-সম্পদ, গাড়ী, বাড়ি, এতো বড় ফ্যামিলি তোকে সুখী করেনি?
-সুখ আসলে আপেক্ষিক ব্যাপার। এটা একেকজনের কাছে একেকরকম ভাবে ধরা দেয়।
-শোন স্বর্ণা, তুই যতই লেকচার দিস, আমি জয়ীতাকে কোনদিনই মেনে নেবো না! মাই ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড! দেখে নিস!!
-দু’একদিন রাগ করে থেকে তোমার মন নরম হয়ে যাবে, ভাইয়া। তারপর তুমি তাহামিদ আর জয়ীতা দুজনকেই বুকে টেনে নেবে।
-না, একুশ বছর আগের কথা তোর মনে নেই? সেদিন কি আমি হার মেনে ছিলাম? আমি আজও হার মানবো না!
-একুশ বছর আগের ভূমিকায় তুমি কারো পিতা ছিলে না। তুমি ছিলে ঊনিশ বছরের এক বোনের বড়ভাই। বোনের চুলের মুঠি ধরে,টেনে, হিঁচড়ে, ঘরে তালাবন্ধ করে ফেলে রেখে তার প্রেমকে কবর দিতে পেরেছিলে, কিন্তু সন্তানের বেলায় তা বোধহয় সম্ভব হবে না! পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে পরাজিত সন্তানের কাছে। জয়ীতাকে ফিরিয়ে আনো, ভাইয়া।রাত হয়ে যাচ্ছে, আমাকে ফিরতে হবে।
আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে! মানুষ কেন যে একেক সময় একেক রকমের হয়! একদম শরতের আকাশের মত বহুরূপী!!!
জয়ীতার বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ভাইয়া খুব বাড়াবাড়ি রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেললো। আমি ভেবেছিলাম ফয়সাল আমাকে জয়ীতার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথা শোনাবে। কিন্তু না।ফয়সাল এ ক্ষেত্রে আমাকে একেবারে অবাক করে দিল।
-শোন স্বর্ণা , বিয়েটা আসলে প্রত্যকের নিজের পছন্দেই করা উচিৎ! যেমন ধরো, আমি যদি কায়েসের বিয়েতে তোমাকে না দেখতাম, আর প্রথম দেখাতেই প্রেমে না পড়ে যেতাম তাহলে আজ কি আমি এমন সুন্দর একটা জীবন গড়তে পারতাম? অবশ্য তুমি আমাকে কোনদিন ভালবেসেছো কিনা এখনো বুঝতে পারিনি!
-আরাম কেদারায় বসে জীবনটা কাটিয়ে দিলে তো! বুঝতেও পারলে না, কত ধানে কত চাল হয়!
-মানে?
-মানে জয়ীতার বিয়েতে তো কিছু একটা গিফ্ট দেয়া উচিৎ, নাকি?
-সে আমার ভাবা আছে। আগামীকাল বিকেলে আমরা তিনজন মিলে গিফ্ট কিনে সোজা ভাইয়ার বাসায় যাবো।
-বিয়ে তো এখনো সাতদিন! কাল গিফ্ট নিতে হবে কেন?
-কারন, জয়ীতার বিয়ের পুরোসেট গয়না তুমি দেবে। তুমি তার একমাত্র ফুপু প্লাস বন্ধু!
-একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না?
-আর জয়ীতা তো আমাদের কাছে আলাদা নয়, স্বর্ণা !
ঝলমলে আলোক-সজ্জা। তাহমিদ আর জয়ীতার মুখে স্বপ্ন জয়ের হাসি। এ হাসি অমলিন থাক আজীবন। সবার জীবনে এ হাসি হাসার সৌভাগ্য হয় না!
চেনা-অচেনা কত মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে কতকাল পরে।
ভাইয়ার ইউনিভার্সিটির মোটামুটি সব বন্ধুরা এসেছেন। অট্টোহাসিতে গলে পড়ছেন একে অন্যের গায়ে। পুরাতন দিন, হারানো দিন যেন কয়েক মুহুর্তের জন্য ফিরে পাওয়া।
সেই শত মানুষের,শত চোখের মাঝে কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে শান্ত দিঘীর মত দুটো চোখ কী যে মায়াভরে আমার মুখের দিকে কয়েক মুহুর্ত থমকে গেল! থমকে গেলাম আমিও। কত হাসি, কত গান, কত কবিতা থমকে দিয়ে একদিন মাঝপথে সেই হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম দুজনেই! জয়ীতার মত, তাহমিদের মত আমরা সাহসী ছিলাম না বলে!
ফটোসেশন চলছে! কত স্মৃতিময় ক্ষন ক্লিক ক্লিক শব্দে ফ্রেমবন্দী হয়ে যাচ্ছে। আমি দুর থেকে মুগ্ধ চোখে দেখছি তা। আমি কি আরো কাউকে খুঁজছি আর একটিবার দেখার আশায়। একুশ বছর আগে যাকে হারিয়েছিলাম!
ভাইয়ার ডাকে একটু যেন কেঁপে উঠলাম।
-স্বর্ণা , জয়ীতার সাথে ছবি তুলবি না?
-তুলবো, ভাইয়া।
একজন ভাই তার ছোটবোনটাকে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেন তার বোনটি আজ হারানো দিনকে ভেবে চোখের পানি আড়াল করতে ব্যস্ত না হয়! এই এমনি একটা দিনের জন্য একুশ বছর আগে বোনটি তার ভাইয়ের হাতদুটো ধরে বড্ড বেশী বায়না করেছিল!
স্টেজে উঠে ভাইয়া ফয়সালকে বললেন, তোমার ক্যামেরায় ছবি তোলো ফয়সাল! এ ছবির ক্যাপশন হবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছোটবোন!!
ছবি তোলা শেষে হঠাৎ ভাইয়া শিশুর মত কেঁদে উঠে আমার মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। মাথায় চুমু খেয়ে অস্পষ্ট গলায় ক্ষীন স্বরে বললেন, ক্ষমা করিস….! আমি সম্পূর্ন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ভাইদের বুকেও বোনদের জন্য এমন গোপন ব্যথা থাকে বুঝি!
সব আয়োজন শেষে ঘরে ফিরছি ফয়সাল , আমি আর আমাদের সন্তান হীয়া। ফয়সালের মনটা কেমন যেন ভার। খুব শান্ত স্বরে জানতে চাইলো
-ভাইয়া তোমাকে বুকে নিয়ে এতো কাঁদছিলেন কেন জানো,স্বর্ণা?
আমি কেমন যেন চমকে গেলাম। কথা বলছি না দেখে ফয়সাল নিজেই বললো,
-আজ জয়ীতার মাঝে ভাইয়া তোমাকে দেখেছিলেন। একদিন তুমিও তো জয়ীতার মতই ছিলে!
পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য ব্যাপার হলো একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষের মনের আকাশটা দেখতে পারে না । পারে না বলেই হয়তো প্রতিদিন নতুন করে সূর্য ওঠে।
জীবনের গল্প