এই দেশে জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য অনেকগুলি স্বতন্ত্র গবেষণা হয়েছে । রহমান ও কাসেমের গবেষণা ( ২০১১ ) অনুযায়ী , দেশে জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা ৭০। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ৩৩ টি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনকে শনাক্ত করেছিলাে । পরে , ২০০৯ সালে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলােও ৩৩ টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে বলে সরকারকে রিপাের্ট দেয় । জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা কম – বেশি হয় । কৌশলগত কারনে ওদের চেহারা বদলায় , নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে । রহমান ও কাসেমের গবেষণায় ( ২০১১ ) দেখা যায় , দেশে ১৮ জানুয়ারি , ১৯৯৯ থেকে ৪ নভেম্বর , ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ১ শ’টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে । বােমা হামলায় নিহত হয় ১৩৬ জন , আহত হয় ২ হাজার ৪৮৮ জন । বাংলাদেশে উল্লেখযােগ্য কিছু জঙ্গি হামলার ঘটনা তুলে ধরা হলাে- ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ মাস যশােরে উদীচী শিল্পগােষ্ঠীর ওপর প্রথম বােমা হামলা হয় । ওই বােমা হামলায় মারা যায় ১০ জন , আহত হয় ১০৬ জন । একই বছরের অক্টোবরের ৮ তারিখে খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বােমা হামলায় মারা যায় আট জন , আহত হয় ৪০ জন । ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে বােমা হামলায় ১০ নিহত ও ১ শ’রও বেশি আহত হয় । ২০০১ সালের শেষের দিকে , ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বরে , আওয়ামীলীগের নির্বাচনী সভায় জঙ্গিদের বােমা হামলায় যথাক্রমে ৮ ও ৪ জন মারা যান । আহতের সংখ্যা শতাধিক । ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় শক্তিশালী দুটি বােমা হামলায় মারা যায় ৩ জন , আহতের সংখ্যা ছিল ১২৫ – এরও বেশি । একই বছরের ৭ ডিসেম্বর সিরিয়াল বােমা হামলা চালানাে হয় ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলিতে । মারা যায় ১৮ জন , আহত হয়েছিলেন ৩ শ ‘ । ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জে শহরে দানিয়ার এক মেলাতে বােমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ৮ জনকে । আহত হন অনেকে । ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের শাহজালাল দরগায় এক বােমা হামলায় ১০ জন মারা যায় এবং আহত হয় ১৩৮ জন । ২১ মে , ২০০৪ সিলেটে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনােয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানাে বােমা হামলায় তিনি বেঁচে গেলেও মারা যায় অন্য দু’জন , আহত হয় ২০ জন । একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামীলীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটে । এতে নিহত হয় ২৪ জন , আহত হয় পাঁচ শতাধিক । আওয়ামীলীগ প্রধান তকালীন বিরােধী দলের নেতা শেখ হাসিনা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও মারা যান মহিলা আওয়ামীলীগ প্রধান আইভি রহমান । ২০০৫ সালে ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বােমা হামলায় মারা যায় ৩ জন , আহতের সংখ্যা সত্তরের অধিক । একই মাসে হবিগঞ্জের বৈধর বাজারে আওয়ামীলীগের সমাবেশে বােমা হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী গােলাম কিবরিয়াসহ পাঁচ জন । আহত হয় ১৫০ জন । ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযােগে ৬৩ জেলায় বােমা হামলা হয় । জঙ্গিরা তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা কেমন তা দেশবাসীকে জানান দেয় এভাবেই । নভেম্বরের ১৪ তারিখে ঝালকাঠিতে দু’জন সহকারী জেলা জজকে বােমা মেরে হত্যা করা হয় । ২৯ নভেম্বরে চট্টগ্রাম , গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে একসঙ্গে বােমা হামলা করা হয় । এ হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯ , আহতের সংখ্যা ৭৮। ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে এক বােমা হামলায় নিহত হয় ৮ জন , আহত ৪৮ জন ।প্রসঙ্গত , ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বােমা হামলায় এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৭ , সেটা ২০০৪ সালের ঘটনা । ২০০৫ সালে বিভিন্ন হামলায় মােট নিহতের সংখ্যা ৩৬। আহতের দিকে দিয়ে ২০০৫ সাল এগিয়ে ( ৯৫২ জন ) ; তারপর রয়েছে ২০০৪ সাল ( ৭৬৫ জন ) । দেশের ভিতরে যে সকল জঙ্গি সংগঠন সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী তাদের সৃষ্টি , উদ্দেশ্য , পরিধি , অর্থায়নের উৎসসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্যের আলােকপাত জরুরী । ১৯৯২ সালে Harkat – ul – Jihad – al Islami ( HUJI ) ওসামা বিন লাদেনের সহযােগিতায় শওকত উসমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে শাখা খােলা হয় । উদ্দেশ্য ছিলাে , জিহাদের মাধ্যমে ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা । বিন লাদেনের আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক ছিলাে । কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ছয়টি ক্যাম্প করে সৌদি আরবের অর্থায়নে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রসহ রােহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে । এ জঙ্গি সংগঠন দেশের দেওবন্দ আদর্শের অনুসারী মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদেরকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়ােগ দিত । ২০০১ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম বেড়ে যায় । সংগঠনটি বন্ধের জন্য বিদেশিদের চাপের মুখে সরকার ২০০৫ সালে অক্টোবর মাসে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করে । ১৯৯৪ সালে হিজবুত তৌহিদ নামে আরেকটি সংগঠন একইভাবে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে , যা পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় । ১৯৯৪ সালে প্রফেসর ড . আসাদুল্লাহ আল গালিবের নেতৃত্বে Ahle Hadith Andolon , AHB বাংলাদেশি শাখা Ahle Hadith Andolon , Bangladesh , AHAB খােলা হয় । AHB একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন । এ সংগঠন ৪২ জেলায় ৭ শ ’ মাদ্রাসায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে । দক্ষিণ এশিয়া ও সৌদি আরবের আল কায়েদার সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কথা রাজশাহীতে সংগঠনটির একটি কনফারেন্সে প্রকাশ পায় । ড , গালিব সংগঠনের কর্মীদের জেএমবি ও হুজি সামরিক প্রশিক্ষকের মাধ্যমে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেন । পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায়ও নেতা – কর্মীদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন । ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় ড . গালিবকে । তার কাছ থেকে জানা যায় অর্থায়নের উৎস । অর্থায়নের উৎস হিসেবে সৌদি আরবের ‘ হায়েতুল ইগাচ্ছা ও কুয়েতের ‘ সােসাইটি ফর দি রেনেস অব ইসলামিক লিগেসি ‘ নামক দুটি সংগঠনের নাম জানা যায় । সশস্ত্র ‘ শাহাদাত আল হিকমা ’ ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । ২০০১ সালে এটি এনজিও হিসেবে কার্যক্ষম শুরু করে । নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ কাওসার হােসেন । দেশে জেএমবি , তৌহিদি জনতা , বিশ্ব ইসলামিক ফ্রন্টসহ আরও দুটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে ‘ শাহাদাত আল হিকমা’র গভীর সম্পর্ক ছিল । কাশ্মীরের ‘ লস্কর – ই – তৈয়বা’সহ নেপালের সশস্ত্র মাওবাদীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতাে ওরা । দুবাইভিত্তিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম সংগঠনটির মূল অর্থায়নকারী । পাশাপাশি , ‘ জামাতুলমুজাহিদিন বাংলাদেশ’- জেএমবি , ‘ বিশ্ব ইসলামিক ফ্রন্ট’সহ অনেক জঙ্গিবাদী সংগঠনও অর্থায়ন করতাে তাদের । ১৯৯৮ সালে ‘ জামাতুলমুজাহিদিন বাংলাদেশ – জেএমবি Ahle Hadith Andolon , AHD- এর আদর্শ অনুসরণ করে গঠিত হয় । এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা সাইদুর রহমান । বাংলাদেশের জঙ্গি জগতে AHAB- এর প্রধান ড . গালিবের সঙ্গে সাইদুর রহমানের সবচেয়ে সুসম্পর্ক ছিলাে । তারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে কীভাবে রাজনৈতিক মদদে প্রসারিত করা যায় , তা নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অনেকবার সভা করেছিল । আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন লস্কর – ই – তৈয়বার সঙ্গে জেএমবির নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী । ২০০৫ সালে এক ঘণ্টার মধ্যে দেশের ৬৩ টি জেলায় বােমা হামলা চালিয়ে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়েছিল এ জঙ্গি গ্রুপটি । দলটির রয়েছে শক্তিশালী সুইসাইড স্কোয়াড । ২০০৩ সালে এর কিছু সদস্য ইউরেনিয়াম অক্সাইডসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে । ২০০৫ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি এটি নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় । জেএমবির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা , সংগঠনটি গােপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে । — আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ হিজবুত – তাহরীর ’ বাংলাদেশে শাখা খােলে ২০০০ সালে মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে । বিশ্বব্যাপী খেলাফত ও মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই সংগঠনটির উদ্দেশ্য । সংগঠনটির কোন গঠনতন্ত্র কিংবা সাংগঠনিক কমিটি নেই । দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ‘ হিজবুত – তাহরীর’র কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করা হয় । ২০০৯ সালে ২২ অক্টোবর সরকার এটি নিষিদ্ধ ঘােষণা করে । ‘ ইসলামিক বিপ্লবী পরিষদ ’ নামক জঙ্গি সংগঠনটি ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে । জঙ্গি গ্রুপটির উদ্দেশ্য ছিল , আফগানিস্তানের তালেবানি স্টাইলে শরিয়াভিত্তিক সমাজ কায়েম করা । আফগান – ফেরত যােদ্ধাদের অর্থায়নে এর জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত । আল্লার দল ’ নামের জঙ্গি সংগঠনটি জিহাদের মাধ্যমে দেশে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য AHAB ও JMB- এর সহযােগিতায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে । মনে রাখতে হবে , বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ বা জঙ্গি গােষ্ঠীর উত্থানের আশঙ্কার পেছনে ধর্মীয় উগ্রতার চেয়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির সুবিধাবাদই বেশি দায়ী । নারীবাদী লেখিকা : রুকসানা রহমান