দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে উগ্র মৌলবাদ এখন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা । এই মৌলবাদ চরমবাদে এবং চরমবাদ জঙ্গিবাদে রূপ নিচ্ছে । নির্মম বাস্তবতা হলাে , জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিবাদের সম্ভাব্য উত্থান এই অঞ্চলের শান্তি , নিরাপত্তা , উন্নয়ন ও সভ্যতার জন্য বড় আকারের হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে । অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে জঙ্গিবাদ বিস্তারের পরিধির তারতম্য থাকলেও এর পিছনে রাজনৈতিক ভূমিকা প্রায় একই । অপরাজনীতির কারণেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতাে সমাজে জঙ্গিবাদের শিকড় খুব গভীরে । উদাহরণস্বরূপ , এই দুটি দেশেই জঙ্গি গােষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকরা জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখে । ভারতেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে গুজরাটের দাঙ্গা এবং অতিসম্প্রতি সংখ্যালঘু মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গরিব মানুষদের নানা সরকারি সুযােগ – সুবিধার প্রলােভন দেখিয়ে হিন্দুত্বকরণ হচ্ছে । ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ জঙ্গিবাদে রূপ না নিলেও দেশটির বহু প্রদেশেই রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ রয়েছে । শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয় , জঙ্গিবাদ এখন বৈশ্বিকভাবে প্রধান সমস্যা । দুদশক আগেও শুধু আল কায়েদা এবং তালেবান নামে দুটি জঙ্গি সংগঠনের বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলাে । এখন এই দুই সংগঠনসহ নাইজেরিয়াতে বােকো হারাম , সােমালিয়াতে আল – শাহব , সিরিয়াতে আইএস , বিন লাদেন – ফ্রন্ট লাইন ও আল নুসরা এবং লিবিয়াতে আনসার আল – শরিয়ার মতাে বহু জঙ্গি সংগঠন রয়েছে । পশ্চিমা গােয়েন্দা । রিপাের্ট অনুযায়ী , সারা বিশ্বে ছােট বড় সর্বমােট জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা পাঁচ হাজার । ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি ক্যাফেতে জঙ্গি হামলা হয় । এর রেশ কাটতে কাটতেই ওই বছরের ৮ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে রম্য সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ শার্লি এবদো ’ র কার্যালয়ে জঙ্গী হামলায় নিহত হন পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদকসহ আট সাংবাদিক , দুই পুলিশ সদস্য ও অন্য দুজন । জঙ্গিবাদের সমস্যাটি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে , এখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতেই জঙ্গিবাদ জন্ম নিচ্ছে । বাইরে থেকে গিয়ে জঙ্গি হামলা করার প্রয়ােজনীয়তা আর নেই । তবে এখনও পশ্চিমা বিশ্বে হােম – গ্রোন ‘ জঙ্গি গােষ্ঠীগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার মতাে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি । বিশ্বে এখনও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানই জঙ্গি গােষ্ঠীর সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা এবং এই দেশ দুটিই বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ রপ্তানি করে বেড়াচ্ছে । বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠনের অধিকাংশই পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান – কেন্দ্রিক । অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশেও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জন্যই কিছু কিছু রাজনৈতিক দল আদর্শিক এবং সামাজিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় উগ্র গােষ্ঠীগুলােকে । তাই এ দেশেও এক সময় এই উগ্রবাদ জঙ্গিবাদে রূপ নিয়েছিলাে । অপরাজনীতির কারণেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতাে সমাজে জঙ্গিবাদের শিকড় খুব গভীরে । সুন্নি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট ( আইএস ) ইসলামিক খেলাফত ঘােষণার পর দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বেশ ঝুঁকিতে পড়ে যায় । একটি নীরব হুমকি রয়েছে এই অঞ্চলের প্রত্যেক দেশের জন্য । সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা থেকে ‘ আইএস ‘ এর চার সদস্যকে গােয়েন্দারা আটক করে । পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কেন্দ্রিক আল কায়েদা এবং তালেবানের বহু শীর্ষনেতা তালেবান নেতা মােল্লা ওমরকে বাদ দিয়ে আবু বকর আল বাগদাদিকে বিশ্বস্ত নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে । দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই আইএস তাদের সদস্য নিয়ােগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে । বিশেষ করে পাকিস্তান থেকেই বেশি সদস্য নিয়ােগ করছে তারা । আইএস ‘ এর তথাকথিত ইসলামিক খেলাফতের ভৌগােলিক সীমারেখা যে কেবল সিরিয়া এবং ইরাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় , তা তারা বিশ্ববাসীকে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে । ফলে বাংলাদেশের মতাে জঙ্গি – উত্থানের জন্য সম্ভাবনাময় দেশগুলির চিন্তা বহু গুণে বেড়ে যাওয়াই যৌক্তিক ও সঙ্গত । বাংলাদেশের জঙ্গি রাজনীতির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় , কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ১৯৮০ সাল থেকেই তাদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পরিচালনা করে আসছে । মােহাম্মদ আজিজুর রহমান এবং মােহাম্মদ বিন কাসেম ২০১১ সালে একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন যে , আমরা ঢাকাবাসী ও ‘ খাতুমে নবিয়াত আন্দোলন ‘ ( এটি পাকিস্তানের অংশ ) ১৯৮০ সালে থেকে পাকিস্তানের খাতুমে নবিয়াতের অর্থায়নে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে । সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বারটিল লিন্টনার ১৯৯১ সালে কক্সবাজারের রােহিঙ্গাদের উপর একটি প্রতিবেদন নির্মাণ করেন । সে প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে , ১৯৮০ সালের প্রথমদিকে কক্সবাজারের রােহিঙ্গারা তাদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন Rohingya Patriotic Front ( RFT ) ভেঙে মােহাম্মদ ইউনুসের ( আরকান ) নেতৃত্বে Rohingya Solidarity Organisation ( RSO ) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে । সংগঠনটির কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা উখিয়া থেকে পরিচালিত হয় । জঙ্গিবাদের সমস্যাটি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে , এখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতেই জঙ্গিবাদ জন্ম নিচ্ছে । লিন্টনার আর উল্লেখ করেন যে , RSO বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী , আফগানিস্তানের গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজবি – ই – ইসলাম , কাশ্মীরের হিজবুল – মুজাহিদিনসহ বহু জঙ্গি সংগঠন থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযােগিতা পেয়ে আসছে । আফগান জঙ্গি প্রশিক্ষকরা উখিয়াতে RSO এর কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে । তিনি লিখেছেন : Afghan Instructors were seen in some of the RSO camps along with the Bangladesh – Burma border while nearly 100 RSO rebels were reported to be undergoing training in the Afgan province of Khost with Hizb – e – Islami Mujahideen . . ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশি মুজাহিদিন আফগানিস্তানে গিয়েছিলাে তকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে । যুদ্ধ সমাপ্তির পর তারা দেশে ফিরে আসে । বাংলাদেশকে একটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে । কত সংখ্যক বাংলাদেশি মুজাহিদিন সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি । তবে তখনকার ডানপন্থী রাজনীতির আদর্শিক বন্ধু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকার বাংলাদেশি মুজাহিদিনদের মদদ দিয়েছিল বলে জানাচ্ছেন লিন্টনার , ২০০২ সালে মােহাম্মদ গােলামের বরাত দিয়ে এক লেখায় তিনি উল্লেখ করলেন : The late Bangladeshi scholar Muhammad Gulam agrued that Maj . Gen . Ziaur Rahman , who seized power in the middle 1970s Osuccessfully changed the image of Bangladesh from a liberal Muslim country to an Islamic country . জিয়াউর রহমানের এই ভূমিকার পিছনে মূল কারণটি ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন – ভারত বলয়ের বিরােধী শক্তি আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা । সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বারটিল লিন্টনার ১৯৯১ সালে রােহিঙ্গাদের উপর একটি প্রতিবেদন নির্মাণ করেন । জেনারেল এরশাদের শাসনামলে কোনাে শক্তিশালী উগ্রবাদী কার্যক্ষম লক্ষ্য করা যায়নি । এর পেছনে মােটা দাগে দুটি কারণ ছিলাে । প্রথমত , আফগান – সােভিয়েত যুদ্ধে দেশীয় মুজাহিদরা আফগানিস্তানের মুজাহিদদের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাে । ফলে ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনাে ধরনের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি । দ্বিতীয় কারণটি হল , জেনারেল এরশাদের
রুকসানা রহমান