নারী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ! এমনই নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত সাইনবাের্ড আমাদের দেশের প্রায় মসজিদগুলােতেই দেখা যায় । ইসলামের কোনাে ধর্মগ্রন্থে এসংক্রান্তে কোনা বিধিনিষেধ আছে বলে আমার মনে হয় না । অবশ্যই নেই । বিশ্বের অন্যকোনাে দেশে মসজিদে নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয় , এমন কোনাে নিয়মও আমার জানা নেয় । মসজিদে নারীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই ধর্মসম্মত নয় , এটা আমি নিশ্চিত । তাহলে ইসলামের জন্মভূমি সদূর আরব দেশগুলাের মসজিদে হরহামেশাই নারীরা প্রবেশ করতে পারতাে । পুরুষের সাথে একত্রে নামাজ আদায়ও করতে পারতাে না । মসজিদে নববী , আল – আকসাসহ অন্যান্য বড় বড় মসজিদগুলােতে ও কাবা শরীফে নারীরা যাচ্ছেন কীভাবে ? ওই মসজিদগুলােতে নামাজও আদায় করছেন পুরুষের পাশাপশি হাজারাে নারী । এটা যদি বাস্তবেরই অংশ হয় , তাহলে বলতে হয় , আমাদের দেশে ধর্মান্ধরাই নারীদের ক্ষেত্রে মনগড়া এইসব নিজস্ব রীতিনীতি প্রয়ােগ করছে । এই রীতিনীতি কোনােভাবেই ইসলামসম্মত নয়ই বরং ইসলামের সাথে সম্পূর্ণভাবেই সাংঘর্ষিক । চলার পথে ঢাকার একটি মসজিদের একটি ছােট্ট সাইনবাের্ডে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে । তাতে লেখা রয়েছে নারীদের প্রবেশ নিষেধ । ‘ লেখাটি পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি , সাথে সাথে একরাশ হতাশও আমাকে ভর করেছে । কেননা এই নিষেধাজ্ঞা , কেনাে নারী মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না , তা উল্লেখ করা নেই । আমার মনে হয়েছে , নিরাপত্তার বিষয়টিকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ । তবে কাদের নিরাপত্তা ? নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চয় ! আমার প্রশ্ন , ধর্মালয়ে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকলাে কীভাবে ? ঢুকালােই বা কার ? ধর্মালয়ই তাে এমনিতেই সকলের জন্যই নিরাপদ স্থান । সেখানে নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা বা কোনাে যৌক্তিক কারণ আছে কি ? যদি কোনাে ধর্মালয়ে কোনাে বিশেষ শ্রেণীর মানুষের ( নারী ) নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন আসে , তাহলে সেটাকে ধর্মালয় বলার কোনাে সুযােগ থাকতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস । ওখানে তাে স্রষ্টার আরাধনা করা হয় , ইবাদত বন্দেগীর পবিত্রতম স্থান । ওখানে যারা যান , তারা তাে প্রভুর ভয়ে ভীত থাকেন । প্রভু ভীতির পরও কারাে মনে কোনাে ধরণের পাপচারের উদ্রেগ হতে পারে কী ? মসজিদে নারী প্রবেশ করলে পুরুষদের কামভাৰ জাগ্রত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে ! কখনােই না । বরং পরােক্ষভাবে এটাই প্রচার করা হয়েছে , ‘ নারী তুমি কোথাও নিরাপদ নও । ‘ রাস্তা – ঘাটে , বাসে – ট্রেনে , শিক্ষালয়ে , কর্মক্ষেত্রে নারী অনিরাপদ বলে মসজিদেও কী তারা নিপত্তাহীনতায় ভুগবে ? এটা পুরুষের কোন্ ধরণের ভাবনা ! এই ধরণের ভাবনা কি পাপ নয় ? নারীদের প্রবেশ নিষেধ ‘ লেখা সম্বলিত সাইনবাের্ডটটি পুরুষের হিনমন্যতারই বহিপ্রকাশ করেছে বলেই আমার কাছে প্রতিয়মান হয়েছে । নারীর প্রাপ্ত মর্যাদা নিশ্চিত করলে , নারীর অধিকার নিশ্চিত হলে , ধর্মান্ধতা থেকে পুরুষ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলে , পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই শুধু ধর্মালয় কোনাে , সর্বক্ষেত্রেই নারী নিরাপদ থাকবে , এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় । তার আগে ভাবতে হবে নারী মানব জাতিরই অংশ কিনা ? এক ‘ আদম ’ দিয়ে পৃথিবী মানব – মানবীতে পরিপূর্ণ হয়নি । হয়নি এক থেকে ৭শ ’ কোটিতে । প্রয়ােজন হয়েছে ‘মা হাওয়া ’ রও । মা হাওয়া কিন্তু একজন নারী , এটা নতুন করে কাউকেই বুঝিয়ে দেয়ার অপেক্ষা করে না । তাহলে নারী আর পুরুষের বিভেদটা কোথায় ? নারীকে ‘ ঘরবন্দি রাখার মতলবি বিষয়টি পুরুষের মাথায় তাে কোনাে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ ঢুকিয়ে দেয়নি ! ধর্ম যেটাকে ধর্মসম্মত বলেনি , তাহলে সেটার উদ্ভাবক কারা বা কোন্ গােষ্ঠী ? এটাবলার অপেক্ষা রাখে না , কোনাে ধর্মান্ধগােষ্ঠী সযত্নেই নারীকে আলাদা করার মানসে এটার উয়াবন ঘটিয়েছে । এর থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে । অন্যথায় ধর্মের পূর্ণতা পেতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে , এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় । অন্যান্য ধর্মালম্বিরা তাদের প্রার্থনাগারগুলােতে নারীর প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে না । কোনাে ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে , এমনও নজির নেই । মন্দির , গীর্জা , প্যাগােটা প্রভৃতি ধর্মশালায় নারী – পুরুষ একত্রে তাদের স্রষ্টাবন্দনা করে থাকেন । ধর্মীয় আচার – অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে নারীদের আলাদা করে রাখা হয় না । এমন কোনাে বিধানও তাদের নেই । নিরাপত্তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনাে সংশয় বা আশঙ্কাও থাকে না , প্রশ্নও উঠে না । অন্য ধর্মের প্রার্থনাগারগুলােতে নারীর নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি না হলে , মসজিদে হবে কোন যুক্তিতে ? তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেগ না হলে মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাে তা হওয়ার কথা নয় । ধর্মালয়ে তারা তাদের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে , মসজিদের ক্ষেত্রে কেনাে প্রশ্ন উঠবে ? নারী নিয়ে যতাে উদ্বিগ্ন শুধু কী মুসলমানদের মাঝেই ? তাহলে কি এই প্রশ্নটি উঠবে না , নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে ঘরবন্দি করে রাখা ছাড়া মুসলমানদের আর কোনাে উপায় জানা নেই । নারী নিয়ে যতাে উদ্বেগ শুধুমাত্র মুসলিম সমাজে । অন্য ধর্মে এতাে উদ্বেগ দেখা যায় না । নারী নিয়ে উদ্বেগ শুধু ইসলামে কেনাে , অন্য ধর্মে কেনাে নেই ? এই প্রশ্নের জবাব স্বভাবত সবাই জানতে চাবে । আমার ধারণা , মুসলমানদের হেয় করতে এই ধর্মেরই কিছু লােক ভিতর থেকে ষড়যন্ত্র করছে সেই আদিকাল থেকেই । যা ধর্মে নেই , তা ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা পক্ষান্তরে ইসলামকেই খাটো করছে । ইসলামকে বিতর্কে জড়াচ্ছে । যুগ যুগ ধরে যারা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তারা কিন্তু ধর্মান্ধ নয় , তারা মতলববাজ । আর যারা এইসব ধর্মসন্মত মনে করে ওই মতলবিদের বিভিন্ন সংস্করণ মেনে চলে তারাই ‘ ধর্মান্ধ ‘ । আমার ভয় ওই ধর্মান্ধদের নিয়েই । ওদেরই ভ্রান্ত ফতােয়ায় বলী আমাদের দেশে অনগ্রসরমান মানবগােষ্ঠীর অনেকেই , বিশেষ করে নারী । নারীকে খাটো করে দেখার কোনাে কারণ বা যুক্তি প্রচলিত কোনাে ধর্মে আছে কী ? এর ব্যাখ্যাই বা কী ? প্রচলিত কোনাে ধর্মই নারীকে খাটো করেনি । সমাজই নারীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে যুগ যুগ ধরে । মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টা হলাে ‘ ধর্ম । ধর্মীয় বিষয় মানা – না মানা , অগ্রাহ্য করা , বিপরীতে অবস্থান নেয়ার ওপরেই পরলৌকিক জীবনে সুখ – কষ্ট নির্ভরশীল । এটা অবশ্য পরলৌকিকে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে । মতলবিরা এই স্পর্শকাতর বিষয়টিকেই অপব্যাবহার করেছে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার হাতিয়ার হিসেবেই । ফলে ধর্মান্ধতার সৃষ্টি আমাদের এই সমাজে । যদিও সমাজে মতলবিদের সংখ্যা নেহাতই কম । ওই স্বল্পসংখ্যক মানুষ বিশাল সংখ্যার ওপর ছড়ি ঘােরাতে অভ্যস্থ । তাই ওই মতলবিদেরই প্রধান শিকার হলাে নারী । নারীকে পদানত করা মানে সমাজের অর্ধেক মানুষকে পদানত রাখা । যেহেতু মানব সমাজে অর্ধেক সংখ্যকই নারী । বাকী অর্ধেককে বিভিন্ন কায়দায় রায়ত্ব করে রাখে তারা । তাদের বিশাল অংশই ধর্মান্ধতার শিকার । মতলবি আর ধর্মান্ধ উভয়ই কিন্তু পুরুষ । তবে নারী কিন্তু ধর্মান্ধ হয় না । তারা । ধর্মান্ধদেরই শিকারমাত্র ! পরিবার , সমাজ , রাষ্ট্র ও বিশ্ব গড়ে উঠেছে মানুষকে নিয়ে । এখানে কোথাও কিন্তু শুধুমাত্র পুরুষ বা নারীকে ইঙ্গিত করা হয়নি । গণ্য করা হয় নারী – পুরুষ উভয়কেই । শুধু পুরুষ দিয়ে পরিবার , সমাজ , রাষ্ট্র ও বিশ্ব গড়ে উঠতে পারে না । আবার নারীকে দিয়েও নয় । এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য , নারী – পুরুষ উভয় উভয়েরই পরিপূরক । একটি ছাড়া অপরটি অচল , গুরুত্বহীন । তাহলে একমাত্র পুরুষই কেনাে মনে করবে তারাই একমাত্র হর্তাকর্তা , সর্বক্ষমতার অধিকারী ? নারীকে কেনাে করা হয় অধিকার বঞ্চিত ?
রুকসানা রহমান