শুধু লেখনীর মাধ্যমেই নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না । লেখনীর মাধ্যমে নারীসমাজকে সচেতন করা যায় মাত্র । আমি লিখি নারীর অধিকার নিয়ে । নারী জাগরণ নিয়ে । নারীর নিগ্রহতা নিয়ে । নারী – পুরুষের সমতা যৌক্তিকতা নিয়ে । এসব বিষয়গুলাে নিয়ে লেখা আমি আমার সংগ্রামের অংশ হিসেবে নিয়েছি । অনেকেই আমাকে নারীবাদী লেখিকা হিসেবে বাহবা দেন । আবার অনেকেই তিরস্কারও করেন । আমাদের সমাজে বহু নারীকে জানি যারা নারীমুক্তি আন্দোলনের সাথে থাকেন , নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সােচ্চার থাকেন । নারী নিয়ে লেখেন । তারপরও অনেকে নিজেদেরকে নারীবাদী পরিচয় দিতে চান না । সমাজের কারণে আড়ষ্ট হয়ে থাকেন । এক ধরণের ভয় । কাজ করে তাদের মনের মধ্যে । সেই ভয়টা আসে ধর্মান্ধগােষ্ঠী থেকে । ওই ধর্মান্ধদের দৃষ্টিতে নারীবাদী হওয়া একটা অপরাধ – পাপ । নারীবাদীরা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন এবং নারীবাদীরা সমাজে অস্থিরতা ছড়াচ্ছেন বলে তারা মিথ্যা ধারনা পােষন করেন । অনেকেই আবার নারীবাদকে নাস্তিকতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান । নষ্টা – ভ্ৰষ্টা বলতেও অনেকে দ্বিধা করেন না । আমি বিশ্বাস করি , নারীরা শুধু শাড়ি – গয়নার মধ্যেই জ্ঞান লাভ করবে না। তারা শিক্ষিত হবে , রােজগার করবে , পরিবারে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ করবে । এটা প্রতিষ্ঠা পেলেই নারী অবশ্যই সমমর্যাদা একদিন পাবেই পাবে । এব্যাপারে আমি খুব আশাবাদী যে , একদিন সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার থাকবে , সন্তানের অবিভাবকত্ব পুরুষের ন্যায় নারীও হতে পারবে । নারীবাদী এই ইস্যুগুলাে নিয়ে মােল্লারা তথা ধর্মান্ধরা হৈ চৈ করে । ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক না হলেও , এটাকে তারা ধর্মবিরােধী মনে করে চিৎকার চেচামেচি করেই চলেছে । এটা অবশ্য পুরুষতন্ত্রের নতুন ভাষাই নয় , খেলার নতুন চালও । অনেক নারীও এখন পুরুষের এই চালের গুটি হয়ে গেছেন মােল্লাতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে । নারীবাদ নিয়ে এই ক্ষমতাবান নারী , এমনকি অনেক সাধারণ নারীও পুরুষের শঙ্কার সাথে তাল মেলান । কারন মােল্লাতন্ত্রকে পুরুষই নিয়ন্ত্রণ করে । নারীবাদ বুঝুক বা না – বুঝুক , একটা মেয়ে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে , এই ব্যাপারটি খুব ভয়ঙ্কর পুরুষতন্ত্রের কাছে । তাই পুরুষ শাসিত সমাজ নারীবাদ নিয়ে এতাে বিভক্তি , বিতর্ক আর সংস্কার তৈরী করেছে যে , সাধারণ নারীতাে বটেই , অনেক ক্ষমতাবান নারীও এই মতবাদকে স্বীকার করতে ভয় পান । অনেক সময় নারী অধিকার কর্মীরাও তাই নিজেদের নারীবাদী প্রচারে দ্বিধান্বিত হন , ভয় পান । নারীদের এই বিভক্তি , ভয় আর সংস্কারই পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে । তাই মানসিকতা আর ভিরুতা সমতা প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দেখে দেয় । ডেমি রেবেকা ওয়েস্ট নামের একজন ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , “ নারীবাদ কী আমার ঠিক জানা নেই । আমি শুধু জানি , যখনই আমি আমার ভেতরের আমিকে প্রকাশ করি এবং তা আমাকে পা মােছার পাপােষ বা বেশ্যা হওয়া থেকে আলাদা করে , তখনই লােকে আমাকে নারীবাদী বলে ডাকে ” । পুরুষতন্ত্র যুগ যুগ ধরে চেয়ে এসেছে , নারীদের মধ্যে আদর্শিক বন্ধন গড়ে না উঠুক , নারীরা বিভক্ত হােক , নারীবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হােক । কারণ , পুরুষ জানে নারীবাদ বা ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন ঠিক পুরুষতন্ত্রের কোন জায়গায় আঘাতটা করে । সুতরাং পুরুষতন্ত্রকে আরাে হাজার বছর টিকিয়ে রাখার জন্য নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বিভক্ত করার , নারীবাদ – এর মত গতিশীল একটি মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার , নারীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করার মতাে ভালাে অস্ত্র আর পুরুষের হাতে নেই । । কথিত মানব সভ্যতার শুরু থেকেই পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নারীরা নিজেদের বিপক্ষেই পরােক্ষভাবে অবস্থান নেয় । ফলে নারীবদীরাও বিভক্ত হয়েছে , বহুখন্ডিত হয়েছে । একদল বলে তারা নারীবাদিই নন । আবার একদল প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠে , তারা ‘ ভালাে ’ নারীবাদী আর অন্যরা খারাপ ’ নারীবাদী । একদল ‘ আস্তিক ‘ নারীবাদী তাে অন্যদল ‘ নাস্তিক ‘ নারীবাদী ! এই বিভক্ত নারীরা না – জেনে , না – বুঝে নিজেদের বিভেদ বাড়িয়ে শুধু পুরুষতন্ত্রকেই দীর্ঘজীবি করেছেন । এক শ্রেণীর নারীরাই পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করে গেছেন সভ্যতার শুরু থেকেই । আর তা করতে গিয়ে নারীবাদকেই তারা বিভিন্ন অপবাদ দিয়েছেন । তারা পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের ভাষাতেই নারীবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন । ব্যক্তি নারীকে আক্রমণ করে সমান অধিকারের লড়াই করা নারীদেরকে ‘ তসলিমা নাসরিন নাস্তিক , ডিভাের্স প্রমােট করা , পরিবার অস্বীকার করা , বাচ্চা ঘৃণা করা , পুরুষবিদ্বেষী , ঝগড়াটে , পুরুষ হতে চায় ইত্যাদি বলে ঘৃণা প্রদর্শন করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন । আসলে নারীবাদের সঠিক তথ্যের চেয়ে বিকৃত তথ্য অনেক বেশী প্রচার পেয়েছে । নারীর সমান অধিকার আন্দোলন নিয়ে সবসময়ই বিরক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ । এই সমাজ এমনই শিক্ষা – দীক্ষা , প্রথা – প্রচারণা চালিয়ে এসেছে যেন নারী নিজের অস্তিত্ব , স্বকীয়তা , স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক মানবিক বিষয়ে ভাবার সুযােগ যেনাে না পায় । পুরুষরা নিজেদের সুবিধামতাে জ্ঞান – বিজ্ঞান – দর্শনের চর্চায় অগ্রসর হয়ে যেখানে পৌছে গেছে , সেখানে নারীদের প্রবেশে অন্তরায় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে থাকে । তাই নারীবাদ নিয়ে নারীদের ভয় , সংস্কার তা কিন্তু নারীদের অন্যখানে । অপবাদের ভয় । মৌলবাদীদের আক্রমণে শিকার হওয়ার ভয় । নারবাদী শব্দটিতে নয় , বরং এই ভয় নারীবাদের একশনে । পুরুষতন্ত্রের বানানাে নারীবিরােধী সকল নিয়ম – নীতি ভেঙ্গে , নারীবাদীদেরকে পুরুষের তৈরি অসম নিয়ম , আইন , অসাম্যের পরিবার , সম্পর্ক , ভাষা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ করা এবং প্রতিরােধ করার কাজে লেগে যাওয়া । কিন্তু নারীবাদকে স্বীকার করেও মনের অজান্তে অনেক নারী বিপক্ষে অবস্থান নেন । নারীবাদী চর্চার জন্য যে মনােবল , উদ্যম এবং ঝুঁকি নিতে হয় , তা বেশিরভাগ নারীই নিতে চান না বা পারেন না । কারণ , নারীবাদকে স্বীকার করলে বা চর্চা করলে , নারীরা যৌন – স্বাধীনতাকামী , পরিবার অস্বীকার করা নষ্টা মেয়ে হিসেবে অপবাদেন ভয়ে থাকেন । পুরুষতন্ত্র সমাজ আসলে নারীর মনােজগতকেও নির্মাণ করেছে । নিজেদের মতাে করেই । অনেক নারীই তাই নারীবাদ বােঝেন না , বুঝতে চান না । পুরুষ এটা পছন্দ করে না বলেই । তাই বাংলাদেশে নারীর সমান অধিকারের আন্দোলনে এখনাে নারীদের বড় একটা অংশের কোন সম্পৃক্ততা তাে নেই – ই , ন্যুনতম কৌতুহল পর্যন্ত নেই । নারীবাদ বােঝা ও চর্চার বিষয়টি পুরুষের মতাে অনেক নারীর কাছেও যথেষ্ট বিরক্তিকর । কারণ , নারীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস ও আচরণ এর জন্য সম্যক দায়ি । পুরুষসুলভ নিপীড়ন এবং ক্ষমতালােভের উৎসগুলােকেও নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে । নারীবাদ সেই নারীদের আচরণকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে , যারা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে এবং পুরুষের অনেক হীনমন্যতাকে সমীহ করে । আবার এই যে , পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা , তা শুধু পুরুষদের কাছেই অনাকাঙ্খিত নয় , অনেক নারীর জন্যও যথেষ্ট কষ্টের । কারণ , নারীবাদই একমাত্র মতবাদ যা সুখী সংসারের পুরুষতান্ত্রিক মিথ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে । নারীকে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলাের ভেতরে থেকেই এসব প্রশ্ন তুলতে হয় এবং এর মধ্যেই সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণ করতে হয় । পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলে নারীদের অনিবার্যভাবেই নিজের বাবা – ভাই – বন্ধু – স্বামী – প্রেমিক – পুত্রের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয় । নারীবাদের যাত্রা তাই বড় কঠিন ও বন্ধুর । বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে , নারীবাদী মতবাদ নারী পুরুষ উভয়কেই লাভবান করে । তাই একটি সমতার পৃথিবী সৃষ্টির জন্য নারীবাদের মতাে একটি আন্দোলনকে সবরকম কুসংস্কার মুক্ত করা খুবই জরুরী । আমাদের কন্যাদের এবং পর প্রজন্মের নারীদের এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার পথ তৈরি করতে চাইলে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনাে রাস্তা কিন্তু খােলা নেই , বিকল্প নেই । সুতরাং যেকোনাে সচেতন নারী , সকল অপবাদ আর শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নারীবাদের লড়াই – এ যুক্ত হবেন , সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত । নারীর তাে এক শৃঙ্খল ছাড়া হারানাের আর কিছু নেই ।
॥ রুকসানা রহমান ॥