আমাদের দেশে ‘ ধর্ষণ ’ নামক এই কালব্যাধিটি মারাত্মকভাবেই সংক্রামিত হয়েছে । বলা যায় , এই কালব্যাধীতে আক্রান্ত আমাদের গােটা সমাজই । ঘরে – বাইরে কোথাও নিরাপদে নেই নারী , নারীটি শিশুই হােক আর বৃদ্ধাই হােক । কিশােরী – তরুণীরা রয়েছে তাে আরাে চরম ঝুঁকিতে ! এখন ধর্ষণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না । প্রচলিত অপরাধগুলাের মতােই এর অবস্থান । তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আর পারিবারিক শিক্ষা ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বের অপর্যাপ্ততার কারনে এই জঘন্য বিষয়টির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । তবে এই অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে ইন্টারনেটের ব্যবহারকেও বহুলাংশে দায়ি করা যায় । প্রতিটি মানুষই সৃষ্টিগতভাবে কুপ্রবৃত্তির আওতায় । প্রকৃতিগতভাবে রয়েছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ । পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশেও একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে ধর্ষণ । তবে দুঃখজনক হলেও সত্য , পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতাে আমাদের দেশেও সংক্রমিত হচ্ছে । মূলত সামাজিক মূল্যবােধ , প্রকৃত শিক্ষার অভাব এবং নিচু মানসিকতার কারণেই এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে আমার ধারণা । আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে নানান বয়সী নারী । এমনকি ছোট শিশুরাও নিরাপদ নয় । ঘরে ঢুকে বাবা – মা কিংবা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ , রাস্তায় ভাইকে বেঁধে রেখে বােনকে ধর্ষণ , বেড়াতে যাওয়া শিশুকে ফুসলিয়ে বা চকলেট দিয়ে ধর্ষণ করার ঘটনা গণমাধ্যমের শিরােনাম হচ্ছে । আমি ধর্ষককে যতই তৃণা করি না কেন , ধর্ষক কিন্তু এই কুকর্ম বন্ধ করবে না , যদি প্রতিটি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না যায় । এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়ােগে আরাে যত্নবান হতে হবে । আবার প্রাকৃতিক নিয়মকেও অস্বীকার করা যাবে না । তবে প্রাকৃতিক এই নিয়মটি যথেচ্ছা ব্যবহার অবশ্যই পরিবার থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে । প্রাকৃতিক নিয়ম বলে অথবা ধর্ষকদের ঘৃণা করেই ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না । তবে আলেম সমাজকে স্বইচ্ছাপ্রণােদিত হয়েই ধর্ষণের বিষয়ে ধর্মীয় দীক্ষার দায়িত্ব নেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে । আমাদের দেশের আলেম সমাজ হিসেবে খ্যাতরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ – মহাফিল করে বেড়ান । কিন্তু এসব আলেমরা এই দীক্ষার দায়িত্বটা নিয়েছেন , এমন প্রমান মিলবে না । বিষয়টিও রহস্যাবৃত্ত । ধর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্বপ্রথম ধর্ষণের কারণ চিহ্নিত করা আবশ্যক । অতঃপর এই সংক্রামক ব্যাধিটি থেকে সমাজকে মুক্ত করার উপায় খুঁজতে হবে । ব্যাধিটি স্বমূলে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নয় । দরকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তােলা । ধর্ষককে সমাজচ্যুত করলে এবং সাথে সাথে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অন্যরা এমন অপরাধ করার সাহস হয়তাে পাবে না । ধর্ষণের কিছু কিছু ঘটনার প্রতিবাদ হয় । বিভিন্ন শ্রেণী – পেশার মানুষ ব্যানার – পােস্টার হাতে নিয়ে মিছিল করে , মিটিং করে , মানবন্ধন করে । তবে আলেমসমজাকে এমন আন্দোলনে শরিক হতে দেখা যায় না । এই ধরণের আন্দোলন – সংগ্রামে অংশ নিলে নানা রকম নিপীড়ন , অত্যাচারের শিকার হতে হয় আন্দোলনকারীদের , এমন নজিরও রয়েছে । যার কারণে শুধু ধর্ষণ নয় , বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে । সরকারী – বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান – সংস্থা থেকে সচেতনতামূলক সভা – সেমিনার করেও ধর্ষণের মতাে ঘটণা কমানাে বা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না । এমনকি প্রচলিত আইনেও সুফল মিলছে না । আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রেণী – পেশার মানুষের হাতে হাতে এখন মােবাইল ফোন । ইন্টারনেট আজ ঘরে ঘরে । সামাজিক যােগাযােগের এই মাধ্যমটা অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে সর্বমহলে । ইন্টারনেট আর ইউটিউব সম্পর্কে জানেন না এমন লােক এখন আর পাওয়া যায় না । শিক্ষিত – অশিক্ষিত সকলের কাছে এই দুটো বিষয় অনেক জনপ্রিয় । কি পাওয়া যায় না ইউটিউবে আর ইন্টারনেটে । শিক্ষা , বিনােদন , স্বাস্থ্য , চিকিৎসা , নাচ – গান , নাটক , সিনেমা সবই আছে । আছে পর্নোসাইট , উলঙ্গ নাচ , নগ্নসৈকত – নগ্নক্লাবের অশ্লীলচিত্রসহ দেশ – মহাদেশের অতি আশ্চর্যজনক বহুবিষয়াদী । এছাড়াও ইউটিউবে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে অগণিত ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মীয় ওয়াজ ও ওয়াজ মাহফিলের দৃশ্য । তবে অধিকাংশ ওয়াজের বিষয়বস্তু তেমন একটা ধর্মসংক্রান্ত নয় । ধর্মীয় বক্তাদের বক্তব্যের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে একে অপরের বিষদগার , অপরের সমালােচনা তথা পরনিন্দা । কিছু কিছু বক্তার বক্তব্য শুধু প্রাগঐতিহাসিক যুগের আবেগীয় কাহিনীকেন্দ্রীক । আর কতিপয় বক্তা আছেন দলীয় রাজনীতি নিয়ে । সমাজের বাস্তব অবস্থার কোনাে কিছুই স্থান পায় না তাদের বক্তব্যে । যে যতাে রসালাে বক্তব্য দিতে পারে সে ততােবড় বক্তা । তাদের প্রচার – প্রসারও বেশী । ফলে তাদের ব্যবসার অবস্থাটা হয় ভালাে । কামানও বেশী । ধর্মীয় আবেগই তাদের কাছে মুখ্য । এরা মূলত ধর্মব্যবসায়ী । ধর্ম তাদের কাছে পণ্যমাত্র । এই পণ্যের পসরা সাজিয়ে ইহজাগতিক ফয়দা হাসিলেই তাদেরকে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায় । ধর্ষণ নামক ভাইরাস সমাজ থেকে দূর করতে আলেম সমাজকে এগিয়ে আসা জরুরী । গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তারা পালন করতে পারেন । আলেম সমাজ দায়িত্ব নিলে , বিভিন্ন ওয়াজ – মহফিলে ধর্ষণের বিষয়ে ধর্মীয় আলােকে বক্তব্য দিলে , যুবসমাজকে প্রয়ােজনীয় দীক্ষা দিলে সমাজে ধর্ষণের প্রবণতা বহুলাংশেই নিয়ন্ত্রণ হতাে বলে আমার বিশ্বাস । আলেম সমাজ ধর্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাদের পিছনে জড়াে হতাে লাখাে লাখাে সাধারণ জনতা । বহুলাংশেই নিয়ন্ত্রণ হতাে নারীর প্রতি জুলুম , নির্যাতন ও ধর্ষণ । মানুষ যে ধর্মেরই অনুসারিই হােন না কেনাে , শিশুকাল থেকেই প্রত্যেক শিশুকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা কিন্তু অত্যাবশ্যক । কারণ কোনাে ধর্মই অন্যায় বা অপরাধকে সমর্থন করে না । ধর্ষণের মতাে মানসিক প্রবৃত্তি সৃষ্টি যাতে না হয় , বিদ্যালয়গুলােকেও মানবিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারােপ করা জরুরী । প্রচলিত আইন যেহেতু ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে , সেহেতু বর্তমান আইন সংশােধন করে কঠোরতর আইন ও এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিৎ । বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও দূর করা জরুরী । সাথে সাথে সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমগুলােতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ধর্ষণবিরােধী প্রচার – প্রচারণা চালালে , পর্ণো ভিডিওসহ টিভি চ্যানেলগুলােতে নীতিমালা তৈরি করে অশ্লীল ভিডিও প্রচার বন্ধ করলে , গ্রামগুলােতে অশ্লীল যাত্রাপালা বন্ধ করা সম্ভব হলে এবং ইন্টারনেটে পর্ণোসাইট মুক্ত করা সম্ভব হলে ধর্ষণের প্রবণতা বহুলাংশেই হ্রাস পাবে বলে, আমি মনে করি । এছাড়াও নারীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারী প্রশাসনযন্ত্রকে আরাে দায়িত্বশীল হতে হবে । পরিবার থেকেই নারীশিশুদের প্রতি শ্রদ্ধাবােধের মানসিকতা তৈরি করতে হবে । সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি সদস্যের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসার পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরাে কঠোর হতে হবে । ধর্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে বিচার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই । ভুক্তভােগী ধর্ষিতার প্রতি মানবিক হতে হবে । পরিবার ও সমাজ থেকে ধর্ষককে চূড়ান্তভাবে বয়কট করতে হবে । কেননা বেড়েই চলেছে ধর্ষণের মতাে অমানবিক জঘণ্য ঘটনা । সমাজ – রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না । ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীরাও এককভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম নয় । এটা সত্য যে , নারীরা আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে । আমরা এমন একটা নিরাপদ সমাজ কল্পনা করি , যেখানে বাবা – মা মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে , নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে , কাজ করতে পারবে দুশ্চিন্তাহীনভাবে ।
রুকসানা রহমান